সম্প্রতি রাজশাহীতে ঋণে জর্জরিত হয়ে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে হত্যার পর যুবক আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া ঋণের চাপে আকবর হোসেন (৫০) নামের এক কৃষকও আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
মোহনপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর আতাউর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, তিনি ঋণের চাপে আত্মহত্যা করেছেন। বিভিন্ন এনজিও থেকে তিনি কিছু লোন নিয়েছেন। তবে তার শারীরিক অসুস্থতাও ছিল। তিনি পেটের পীড়ায় ভুগছিলেন। এই দুইটি কারণ মিলিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি।’
আকবর হোসেনের দুই ছেলে। তার পানের বরজ আছে। তিনি ওই পানের বরজসহ অন্যান্য খাতে ব্যবসার জন্য ১১টি এনজিও থেকে গত এক বছরে ছয়-সাত লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে তার ছেলে সুজন শাহ জানান।
তবে ঋণের কাগজপত্রে দেখা যায় সব ঋণই তিনি তার স্ত্রী সেলিনা বেগমের নামে নিয়েছেন। এবার প্রবল বৃষ্টিসহ নানা কারণে পানের বরজ নষ্ট হয়ে গেছে। আবার পানের দামও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঋণের টাকা শোধ করতে পারছিলেন না।
সুজন জানান, ‘আমার বাবা এনজিও থেকে ছয়-সাত লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার পানের দাম নাই। এক বিঘা জমির পান বরজের আয়েই আমাদের সংসার চলত; কিন্তু প্রতি সপ্তাহে ঋণের কিস্তি দিতে হয়। এবার পানের দাম না পেয়ে ঋণ পরিশোধ করতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রতিদিন কিস্তির জন্য এনজিওর লোকেরা চাপ দিতেন। ঋণের চাপে পড়ে বাবা আত্মহত্যা করেছেন।’
তবে সাংবাদিককে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘যা হয়েছে, তা নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। এটা নিয়ে আমাদের ফোন করবেন না।’
যেসব এনজিও ঋণ দিয়েছে সেগুলোর একটির নাম ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস)।
ওই প্রতিষ্ঠানের মোহনপুর উপজেলা শাখার ম্যানেজার মোহাম্মদ রুহুল আমীন দাবি করেন, ‘এক বছর আগে তিনি তার স্ত্রীর নামে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। পানের বরজের ওপর ঋণ দিয়েছেন। তার মধ্যে ছয়-সাত হাজার টাকা শোধ করেছেন। বাকি টাকা শোধ করেননি।’
তার অভিযোগ, ‘এদের ব্যবহার খুবই খারাপ। ঋণের কিস্তি আনতে গেলে খারাপ ব্যবহার করে। তার ছেলে কথা বলে; কিন্তু মা-বাবা আমাদের এড়িয়ে চলে।’
ওই এলাকার ঋণের কিস্তি আদায়কারী মনোয়রা বেগম বলেন, ‘তাদের ৫০ হাজার টাকা বাকি ছিল। কিন্তু আদায় করতে পারছিলাম না। আদায় করতে না পারায় আমরা তাদের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকি। কখনো থ্রেট-ট্রেট দিই। আর তো কিছু করার নাই।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে আমরা কিস্তি আদায় করি। আর সুদ নিই ১৪ শতাংশ।’
এর আগে রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামুনশিকড় গ্রামে ১৫ আগস্ট মিনারুল (৩৫) তার স্ত্রী মনিরা (২৮), দুই সন্তান—দেড় বছরের মিথিলা ও মাহিমার (১৩) মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মরদেহ উদ্ধারের পর স্থানীয়রা জানান, দুই সন্তান ও স্ত্রীকে হত্যার পর স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। আর একটি চিরকুট থেকে জানা গেছে, ঋণগ্রস্ত হয়ে অভাব-অনটন ও খাবার সংকটে তারা এ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
চিরকুটে কার কাছে বা কোনো এনজিওর কাছে তিনি ঋণগ্রস্ত ছিলেন কি না তা লেখা ছিল না।
তবে সোমবার পারিলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মিনারুলের প্রতিবেশী সাঈদ আলী মোরশেদ বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে দেখেছি, মিনারুল এনজিও এবং বিভিন্ন সমিতির থেকে মোট সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল। টিএমএসএস ও গাব নামে দুইটি এনজিও থেকে সে ঋণ নিয়েছিল। কোনো কাজকর্ম না থাকায় তা শোধ করতে পাছিল না। ঋণ শোধের চাপ ছিল। অর্থের অভাবে তার সংসারও চলছিল না। আমার কাছ থেকেও মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে বাসায় জাল ছিল না, তখন আমার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল।’
কারা ঋণ দেয়, কীভাবে দেয়
ইউপি চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মোরশেদ বলেন, ‘একই পরিবারের চার জন নিহত হওয়ার পর আমি নিজ এলাকায় তদন্ত করছি। তাতে দেখা যাচ্ছে এখানে অনেক দরিদ্র পরিবার একাধিক এনজিও এবং সমিতি থেকে ঋণ নিয়েছে। ঋণ দেওয়ার জন্য স্থানীয়ভাবে অনেক সমিতিও আছে। তারা নানা ধরনের ছোট-খাটো ব্যবসার কথা বলে ঋণ নেয়। কিন্তু তারা সেই ঋণ খাবার কিনতেই খরচ করে ফেলে। আর যারা দেয়, তারাও খোঁজ নেয় না। তাদের টার্গেট থাকে উচ্চহারে সুদ আদায়। আবার এক এনজিওর টাকা নিয়ে আরেক এনজিওর ঋণ শোধ করে। এক সময় ঋণ বেড়ে গেলে বিপদে পড়ে। আর এনজিওগুলো লাভ খোঁজে।’
‘আমরা মঙ্গলবার আমার এলাকায় যত এনজিও কাজ করছে, তাদের সবাইকে ডেকেছি। আমরা এলাকায় ঋণ পরিস্থিতি কী তা জানবে। আর কারোর ক্ষেত্রে যাতে এ রকম মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে কী করা যায় তা নিয়ে কাজ করব।’
আত্মহত্যা করা আকবর হোসেন তার স্ত্রীর নামে ১১টি এনজিও থেকে ঋণ নিলেও কোনো এনজিও ঋণ দেওয়ার আগে তা খুঁজে দেখেনি।
টিএমএসএস মোহনপুর উপজেলা শাখার ম্যানেজার মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘কেউ তথ্য গোপন করে ঋণ নিলে আমরা কী করতে পারি? আর কেউ যে কাজে ঋণ নেয়, সেই কাজ না করে টাকা খেয়ে ফেললে আমরা তো আর তা মাফ করতে পারি না। আমরা তো ঋণ দেওয়ার আগে কী ব্যবসা করবে তা জেনে নিই।’
রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রচেষ্টা’ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ফয়েজুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণে দেখেছি, আসলে এই অঞ্চলে এনজিও থেকে যারা ঋণ নেন, তারা কৃষিখাতে বিনিয়োগের জন্য নেন। কিন্তু এখানে কৃষিতে বড় বড় শিল্প গ্রুপ কাজ করে৷ ফলে ওই ঋণের টাকা তারা কোনো কাজে লাগাতে পারে না। আবার অনেকে অভাব মিটাতে ঋণ নিয়ে খরচ করে ফেলে। ফলে তারা শোধ করতে পারে না।’
তার কথা, ‘আমরা হিসাব করে দেখেছি, এনজিওগুলো ১৪ শতাংশ বললেও এই ধরনের ঋণের সুদহার দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ। আর ঋণ নেওয়ার এক সপ্তাহ পরেই কিস্তি শোধ শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয়। ফলে যে টাকা ঋণ নেয়, তা ব্যবহার করতে পারে না। বিনিয়োগ করে আয়ের আগেই মূল টাকা থেকে কিস্তি শোধ শুরু করতে হয়।’
‘এই পরিস্থিতিতে তারা একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নেয়। ঋণ শোধ করতে একাধিক এনজিও থেকে ঋন নেয়। জড়িয়ে পড়ে ঋণের জালে।’
বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে।
৩ আগস্ট মাগুরায় ঋণের টাকা শেধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন কৃষক রিপন শেখ।
২ জুন নাটোরের লালপুরে আর্থিক অনটন এবং ঋণের চাপে স্বামী-স্ত্রী আত্মহত্যা করেন। তারা হলেন, রউজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন।
১৩ মার্চ ফরিদপুরের সদরপুরে সিদ্দিক মল্লিক নামে এক কৃষক আত্মহত্যা করেন। ঋণের চাপে হতাশ হয়ে তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন বলে পুলিশ জানায়।
ঘটনা আরও গভীরে
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, ‘পত্রিকায় হয়তো দুই-একটি ঘটনা প্রকাশ হয়। কিন্তু ঋণের চাপে আত্মহত্যার ঘটনা আরও অনেক ঘটছে। এবং ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থার সংস্কার ও মহাজনি ঋণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা না গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’
তিনি বলেন, ‘এখানে এই ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাপনায় নানা ত্রুটি আছে। কোনো মনিটরিং নাই। কাকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে, কেন দেওয়া হচ্ছে তা বিবেচনা করা হয় না। মূল উদ্দেশ্য থাকে ব্যবসা। আর যারা ঋণ নেয়, তাদের একটি অংশ আয়-বর্ধক খাতে ব্যবহার না করে পরিবারের নানা চাহিদা মিটাতে ব্যয় করে। এটা দারিদ্রের কারণে হয়। জুয়া খেলে ঋণের টাকা খরচ করার উদাহরণও আছে।’
‘তারা একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নেয়। একটা থেকে ঋণ নিয়ে সেটা খরচ করে আরেকটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তা শোধের চেষ্টা করে। একসময় ভিটে-মাটি বিক্রি করেও শোধ হয় না। আর যারা ঋণ দেয়, তারা তো ঋণ মাফ করার জন্য দেয় না।’
মাইক্রো ক্রেডিট অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হার বেশি। কারণ তারা কোনো জামানত ছাড়া ঋণ দেয়। এই হার আরও বাড়ে।’
তার কথা, ‘এই ঋণ নিয়ে দুঃখজনক ঘটনা যেমন ঘটছে, কিন্তু এই ঋণের ‘সাফল্য’ও আছে। ‘সাফল্যই’ বেশি। তারপরও এই দুঃখজনক ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য আমরা কাজ করছি।’
তিনি বলেন ‘প্রচলিত ব্যাংকে সিবিআই সিস্টেম আছে। ফলে, কেউ ঋণ নিতে গেলে অন্য ব্যাংকে ঋণ আছে কি না তা জানা যায়। কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণে সেটা নাই। সেটার জন্য কাজ হচ্ছে, যাতে এটা জানা যায়। ঋণ মনিটরিং সিস্টেম উন্নত করার কাজ হচ্ছে। ঋণ বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে, এখনো গ্রামে মহাজনি ব্যবসা আছে। তার সাথে তুলনা করতে হবে । তাহলে বাস্তব অবস্থা বোঝা যাবে।’
এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দেশীয় এনজিওর সংখ্যা দুই হাজার ৩১৮টি। এর মধ্যে অধিকাংশেরই ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি আছে। এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে আছে মাল্টিপারপাস কোম্পানি, আছে নানা সমিতি ও দাদন ব্যবসায়ী। দেশের তিন কোটি ৫২ লাখের বেশি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবার আওতায় রয়েছে।