বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্রান্তিলগ্নে জ্বালানি শিল্পের একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা জরুরি। জীবাশ্ম জ্বালানি পৃথিবীতে গ্রিনহাউস গ্যাস ছড়িয়ে দিচ্ছে, যার ফলে পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন খারাপ হচ্ছে, আর তার ফলে আর্থসামাজিক বৈষম্যের মাত্রাও বেড়ে চলেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসের একটি বিকল্প কৌশল শুধুমাত্র নয়, বরং এটা ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই উন্নয়নও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায্য রূপান্তরের বিষয়টি বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
জ্বালানি চাহিদার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত সম্প্রসারণশীল, যা বিশ্বব্যাপী এ দেশকে জ্বালানি সম্প্রসারণ ও ন্যায্য রূপান্তরের বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়ে গেছে। দেশে এখনো জ্বীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ব্যাপক নির্ভরতায় কয়লা, তেল ও তরলীকৃত গ্যাস ইত্যাদি আমদানির কারণে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আর জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতা উভয় দিক থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারকে উৎসাহিতকরণের ব্যাপক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও এর পরিমাণ দেশের মোট জ্বালানির সামান্য মাত্র।
উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এবং ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক এশিয়া যৌথভাবে গতকাল সোমবার (২৪ আগস্ট) রাজধানীর একটি হোটেলে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফসিল ফুয়েল নন প্রোলিফারেশন ট্রিট্রি ইনিশিয়েটিভের স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজার হার্জিত সিং। এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের কাছ থেকে অন্যান্য দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে তা শিখেছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৬ ডিগ্রি বৃদ্ধির কারণে আমরা খুবই চিন্তিত।
তিনি বলেন ‘আমাদেরকে নতুন চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। যদি আমরা সচেতন না হই তাহলে আরও সমস্যা তৈরি হবে। আমরা এখনো জ্বীবাশ্ব জ্বালানির ওপরে নির্ভরশীল। নীরব বাণিজ্য যুদ্ধ ও অন্যান্য বাধার কারণে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে জটিলতা তৈরি হচ্ছে।’
হার্জিত সিং বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। অনেক দেশের সক্ষমতা আছে কিন্তু তারা দায়িত্ব নিতে চায় না, কারণ অর্থের যোগান দিতে হবে। প্যারিস চুক্তিতে জ্বীবাশ্ব জ্বালানির কথা একবারও বলা হয় নাই।’
তিনি এ সময় ফসিল ফুয়েল নন-প্রলিফারশন ট্রিটিতে অংশগ্রহণকারী দেশের পরিচিতি তুলে ধরেন।
সভায় অন্যদের মধ্যে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক বদরুল ইমাম, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মোঃ জিয়াউল হক, সেন্টার ফর রিনিউএবল এনার্জি সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী, ফসিল ফুয়েল নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি ইনিশিয়েটিভের এশিয়া ক্যাম্পেইনার শিবায়ন রাহা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের অধিকার ও সুশাসন কর্মসূচি পরিচালক বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক পলিউশন স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ও পটভূমি ব্যাখা করেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব শরীফ জামিল। ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সহ-আহ্বায়ক এম এস সিদ্দিকী সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন।
এ সময় শরীফ জামিল বলেন, ‘গত সরকারের কার্যক্রমে বিদ্যুৎ খাতে সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, আবার সমস্যাও তৈরি হয়েছে। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে কৃষি জমিসহ জনস্বাস্থ্য, লবণ চাষ, জীবন-জীবিকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে। আমাদের সঠিকভাবে পরিবেশ সমীক্ষা করা দরকার ছিল। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের অধিকার ও সুশাসন কর্মসূচি পরিচালক বনশ্রী মিত্র নিয়োগী বলেন ন্যায্য জ্বালানি সংশ্লিষ্ঠ প্রশ্নগুলো কখনোই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে করা হয় না। আমাদেরকে এই জনগোষ্ঠীকে নিয়েও ভাবতে হবে।’
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, ‘জ্বালানি রূপান্তর নির্ভর করে একটি দেশের সক্ষমতার ওপর। আমাদের আমদানি নির্ভরতার কারণে বারবার জ্বালানির দাম বাড়াতে হচ্ছে। তারপরও আমরা চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। আমাদের সম্পূর্ণ জ্বালানি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।’
ফসিল ফুয়েল নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি ইনিশিয়েটিভের এশিয়া ক্যাম্পেইনার শিবায়ন রাহা বলেন, ‘আমরা ভুল সমাধানের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। যেমন, কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প থেকে এমোনিয়া ভিত্তিক কয়লা প্রকল্পের দিকে যাচ্ছি। বাংলাদেশ ফসিল ফুয়েল নন-প্রলিফারশন ট্রিটি’র ১৭টি দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে গুরুপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারে। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি নেতৃত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ‘আমাদের জ্বালানি চাহিদা আছে, অথচ সেই অনুযায়ী উৎপাদন নেই। আমরা সকলে মিলে সচেতন হয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারি। এই ক্যাম্পেইন আরও বিশ্বব্যাপী হওয়া উচিত। তাহলেই আমরা জ্বীবাশ্ব জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে ফেলতে পারব।’
সভায় ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সহ-আহ্বায়ক এম এস সিদ্দিকী সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে এখনো কাজে লাগাতে পারছি না। জ্বীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি আছে অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ট্যাক্স বসিয়ে বাধা সৃষ্ঠি করা হচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষে ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়া (সিএনএএসএ)-এর ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা পলাশ দাস সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন