রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ির অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া পোশাক কারখানার মেশিন অপারেটর ছিলেন নাজমুল ইসলাম। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবারও তিনি যথাসময়ে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুপুর নাগাদ ভয়াবহ আগুনে সেই কারখানাটি পরিণত হয় লেলিহান আগুনের লেলিহিত গহ্বরে।
দগ্ধ হয়ে ১৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। তবে নিখোঁজের তালিকা এখনো দীর্ঘ। তাদেরই একজন নাজমুল ইসলাম। আগুন লাগার পরপরই স্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলেন তিনি। শুধু বলেছিলেন — ‘আগুন আগুন…’ তারপর লাইন কেটে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
নিখোঁজ নাজমুল ইসলামের স্ত্রী জানান, ‘আগুন লাগার পরপরই আমার স্বামী ফোন দেয়। শুধু বলে আগুন আগুন, তারপর ফোন কেটে যায়। এরপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই। আমি ঢাকা মেডিকেল, ইবনে সিনা, ইসলামি মেডিকেলসহ আশেপাশের সব হাসপাতালে খুঁজেছি, কোথাও পাইনি। মালিককে ফোন করলে উনি বলেন, কেউ মারা যায়নি—সবাই নিরাপদে আছে। কিন্তু আমি এখনো আমার স্বামীকে খুঁজে পাইনি।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ওই যে, যখন আগুন লাগে তখন ফোন দিয়েছিল— আগুন আগুন বলে চিল্লাচ্ছিল। ওই ছিল শেষ কথা। এরপর আর কোনো যোগাযোগ নেই।’
এদিকে অগ্নিকাণ্ডে এখনো অনেকের খোঁজ না মেলায় নিখোঁজদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে রূপনগর আবাসিক এলাকার শিয়ালবাড়ি ও আশপাশের সড়ক— কেউ হাসপাতালে দৌড়াচ্ছেন, কেউ খুঁজছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কাছে।
মো. শফিকুল ইসলাম হাতে ভাগনি মাহিরার (১৪) ছবি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনে। চোখে মুখে অশ্রু আর আতঙ্ক। তিনি বলেন, ‘আমার ভাগনি মাহিরা গার্মেন্টসের তৃতীয় তলায় কাজ করত। আগুন লাগার পর থেকে খুঁজছি, কোনো হাসপাতালে পাইনি। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা বলেছে ধৈর্য ধরতে।’
নিখোঁজ নারগিস আক্তারের বড় বোন লাইজু বেগম জানান, ‘আমার বোন সকাল পৌনে আটটায় কাজে আসে। সকাল ১১টার দিকে খবর পাই আগুন লেগেছে। একজন কর্মীর সঙ্গে ফোনে কথা বললে সে বলে— কেউ ভেতর থেকে বের হতে পারেনি। তারপর থেকেই কোনো খোঁজ নাই।’
সরেজমিনে দেখা যায়, শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর সড়কের দক্ষিণ পাশে শাহ আলম কেমিক্যালের দুতলা গুদামটি আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ওপরের তলায় ছিল টিনের ছাউনি। আগুনের সূত্রপাত হয় এই কেমিকেল গুদাম থেকেই। বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলা পোশাক কারখানায়। দুই ভবনের মাঝখানে ছিল সরু একটি রাস্তা, যা আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, মঙ্গলবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে তারা আগুন লাগার খবর পায়। প্রথম ইউনিট ১১টা ৫৬ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি ইউনিট কাজ শুরু করে, পরে আরও সাতটি ইউনিট যোগ দেয় আগুন নিয়ন্ত্রণে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করে গার্মেন্টসে বিস্ফোরণ ঘটে, তারপর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের কেমিকেল গুদামেও। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। পাশে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরাও অগ্নিনির্বাপণ কাজে অংশ নেন।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন দাহ্য রাসায়নিক থাকার কারণে কেমিকেল গুদামের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। মৃতদেহগুলো একে একে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মৃতদেহগুলোর অবস্থা দেখে মনে হয়েছে ডিএনএ টেস্ট ছাড়া তাদের শনাক্ত করা সম্ভব নয়। চেহারা দেখে কিংবা অন্য কোনোভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।’