রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দিন দিন বাড়ছে অজ্ঞাতপরিচয় লাশের সংখ্যা। ফুটপাত, রেলস্টেশন, ডাস্টবিন কিংবা নদীর তীরে প্রতিদিনই মিলছে কারো না কারো নিথর দেহ। পরিচয়হীন এই লাশগুলোই শেষ পর্যন্ত ঠাঁই পাচ্ছে বেওয়ারিশ কবরে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এই বাড়তি অজ্ঞাত লাশ শুধু মানবিক সংকটই নয়, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তার জন্যও বড় সতর্কবার্তা।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে উদ্ধার হয়েছে ৫৫৮টি অজ্ঞাত লাশ। এর মধ্যে অক্টোবরে উদ্ধার হয় ৬৬টি, সেপ্টেম্বরে ৫২টি।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে সংগঠনটি দাফন করেছে ৪৬৮টি বেওয়ারিশ লাশ, আর অক্টোবরে মিলিয়ে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৫৩৪-এ। গত বছর দাফন করা হয়েছিল ৫৭০টি বেওয়ারিশ লাশ, তার আগের বছর প্রায় ৪০০টির মতো।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে বর্তমানে রয়েছে ২৪টি অজ্ঞাত লাশ। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে ছয়টি এবং সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) মর্গে আরও কয়েকটি লাশ শনাক্তের অপেক্ষায়।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন কর্মকর্তা মো. কামরুল আহমেদ বলেন, ‘পুলিশের অনুমতি ছাড়া কোনো লাশ আমরা দাফন করি না। নিজস্ব গাড়িতে করে নির্ধারিত কবরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করি।’
সংস্থার তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ৩৮৬টি এবং জুরাইন কবরস্থানে ৭৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কয়েকটি অজ্ঞাত লাশের সৎকার হয়েছে পোস্তগোলা শ্মশানে।
নদী ও খাল থেকে লাশ উদ্ধারের ঘটনাও বাড়ছে। নৌ–পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশজুড়ে উদ্ধার হয়েছে ৩০১টি মরদেহ, যার মধ্যে ৯২ জনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। গত বছর নদী থেকে উদ্ধার হয়েছিল ৪৪০টি লাশ, এর মধ্যে ১৪১ জনের পরিচয় অজানা রয়ে গেছে।
নৌ–পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান বলেন, ‘নদীতে ভাসমান লাশের পরিচয় শনাক্ত করাই তদন্তের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক সময় পানি ও পোকামাকড়ের কারণে দেহ পচে গিয়ে আঙুলের ছাপ মুছে যায়, ফলে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।’
রেলওয়ে পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৭৬৩ জন, আর সারা দেশে সংখ্যা ৩ হাজার ৯১৮। গত দশ বছরে ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ২৩৭ জনের।
পরিচয় শনাক্ত না হলে এসব লাশ তিন দিন মর্গে রাখার পর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
অজ্ঞাত লাশ পরিবহন ও সংরক্ষণের জন্য পুলিশের বাজেটে বরাদ্দ থাকলেও জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার কারণে সেই টাকা সময়মতো পাওয়া যায় না। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এ কারণে দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী।
মোহাম্মদপুর থানার এক এসআই বলেন, ‘লাশ তুলতে গাড়িচালক টাকা ছাড়া নড়েনি। পোস্টমর্টেম করতেও খরচ দিতে হয়। ফলে লাশ দিনের পর দিন মর্গে পড়ে থাকে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। রাষ্ট্র শুধু লাশ উদ্ধার করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না; পরিচয় শনাক্ত, মৃত্যুর কারণ উদঘাটন ও স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই তাদের দায়িত্ব।’
এমএসএফের পর্যবেক্ষণেও বলা হয়েছে, ‘অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার মানেই নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি। এটা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনমনের ইঙ্গিত দেয়।’

