সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


জুবায়ের দুখু

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২৫, ১২:৩৮ পিএম

বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানের বিমান ছিনতাই করেছিলেন যে যুবক

জুবায়ের দুখু

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২৫, ১২:৩৮ পিএম

ফরাসি পুলিশের হাতে আটকের পর জ্যঁ ক্যুয়ে। ছবি - সংগৃহীত

ফরাসি পুলিশের হাতে আটকের পর জ্যঁ ক্যুয়ে। ছবি - সংগৃহীত

ইতিহাস কখনো কখনো লেখা হয় রাজাদের হাতে, কখনো রাষ্ট্রনেতাদের সিদ্ধান্তে। আবার কোনো কোনো সময় ইতিহাস গড়ে ওঠে একা কোনো মানুষের জেদে- যার কোনো ক্ষমতা নেই, কোনো বাহিনী নেই, কোনো রাষ্ট্রীয় পরিচয় নেই; আছে শুধু একটি অস্থির বিবেক আর মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর দুঃসাহস।

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তেমনই এক সময়, যখন এ দেশের মানুষের রক্তে লেখা সংগ্রামের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজানা-অপরিচিত কিছু মানুষ। কেউ কলম হাতে, কেউ ক্যামেরা হাতে, কেউ আবার নিজের জীবন বাজি রেখে।

তাদেরই একজন ছিলেন এক ‘খ্যাপাটে’ ফরাসি তরুণ- জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে। যিনি কোনো দিন বাংলাদেশ আসেননি, কোনো বাঙালিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না, তবু এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর কষ্ট তার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।

১৯৭১ সালের মার্চের পর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, নারী নির্যাতন, গ্রাম পোড়ানো আর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে ধীরে ধীরে উঠে আসতে থাকে। নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন, প্যারিস থেকে বার্লিন- সবখানেই শিরোনামে জায়গা করে নেয় ‘ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস’।

ভারতজুড়ে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরগুলোতে ওষুধের অভাব, খাদ্যের সংকট আর রোগে-অপুষ্টিতে মানুষের মৃত্যুর খবর বিশেষভাবে আলোড়ন তোলে ইউরোপে। সেই খবর যারা পড়ছিলেন কিংবা দেখছিলেন, তাদের একজন ছিলেন সাবেক ফরাসি সেনাসদস্য জ্যঁ ক্যুয়ে।

জিম্মি হওয়া পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজ (পিআইএ) বোয়িং-৭২০ মডেলের ফ্লাইট-৭১২ বিমান । ছবি- সংগৃহীত

ইয়েমেন ও নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার রক্তক্ষয়ী সংঘাত খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা তার ভিতরে আগেই গেঁথে দিয়েছিল যুদ্ধের ভয়াবহতা। তাই বাঙালির দুর্দশা তার কাছে আর কাগজের খবর ছিল না- ছিল চোখ দিয়ে দেখা পুরোনো দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি।

তার মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন- ‘আমি কী করতে পারি?’ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১: অর্লি বিমানবন্দরের ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে ১১টার ঘর পেরোচ্ছে। রানওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বোয়িং-৭২০ বিমান, ফ্লাইট নম্বর ৭১২।

‘সিটি অব কুমিল্লা’ নামের এই বিমানটি রোম ও কায়রো হয়ে করাচির উদ্দেশে যাত্রা করবে। বিমানে ছয়জন বৈমানিক ক্রু ও ২২ জন যাত্রী। সব কিছু ছিল স্বাভাবিক। টেকঅফের প্রস্তুতি চলছে। ঠিক তখনই বিমানবন্দরের রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভেসে আসে একটি বার্তা- যা শুনে অপারেটরের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

বার্তায় বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষ, বিশেষ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ওষুধ এই বিমানে তুলে পাঠাতে হবে। না হলে বিমান উড়িয়ে দেওয়া হবে।’ বার্তার প্রেরক- জ্যঁ ক্যুয়ে।

তখন বিমানবন্দরের ঘড়িতে দুপুর ১১টা ৫০ মিনিট। মাত্র ২৮ বছর বয়সী জ্যঁ ক্যুয়ে। হাতে ৯ এমএম রিভলবার। অন্য হাতে টেপ মোড়ানো একটি ব্যাগ- যাকে সে বোমা বলে দাবি করছে। এরই মধ্যে বিমানবন্দরের ভেতরে নানায় ব্যস্ততা আর মানুষের ভীর ঠেলে সে সরাসরি বিমানের ককপিটে প্রবেশ করে পাইলটের দিকে অস্ত্র তাক করে ইঞ্জিন বন্ধের নির্দেশ দেয়।

মুহূর্তেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে যায় কর্তৃপক্ষ। অর্লি বিমানবন্দর ঘিরে ফেলা হয়। টার্মিনাল এলাকা খালি করে দেওয়া হয়। সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

কিন্তু খুব দ্রুতই ফরাসি পুলিশ লক্ষ করে- এই ছিনতাইকারী অন্যরকম। সে কোনো টাকা চায় না, কোনো রাজনৈতিক নেতার মুক্তি দাবি করে না, কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকেও কথা বলে না।

তার দাবি একটাই, ‘এই পিআইএ বিমানে করেই বাংলাদেশ ও ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর জন্য ২০ টন ওষুধ পাঠাতে হবে।’

সে স্পষ্ট করে বলে, ‘এই বিমান ছিনতাই বাংলাদেশের যোদ্ধাদের জন্য নয়, এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর জন্য।’

জ্যঁ ক্যুয়ে মানবতার ফেরিওয়ালা। ছবি - সংগৃহীত

ঠিক সেই দিনই ফ্রান্স সফরে প্যারিসে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিম জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট। ফরাসি প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিডুর সঙ্গে তার বৈঠকের কথা ছিল।

পাকিস্তানি বিমানের এই জিম্মি সংকটের কারণে হঠাৎ করেই দুই রাষ্ট্রনেতার সব আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।

ইউরোপজুড়ে টেলিভিশনগুলো সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে। সংবাদ শিরোনামে জায়গা করে নেয় এক অজানা নাম- জ্যঁ ক্যুয়ে। মানবাধিকার ও যুদ্ধবিরোধী মানুষের কাছে তিনি ধীরে ধীরে প্রতীক হয়ে উঠতে থাকেন।

সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়- জ্যঁ ক্যুয়ে বিমানের কোনো যাত্রীকেই জিম্মি করেননি। একে একে সবাইকে নামিয়ে দেন।

সাত ঘণ্টার বেশি সময় বিমানটি আটকে রাখার পর জানা যায়, তার হাতে থাকা ‘বোমা’ ব্যাগে কোনো বিস্ফোরক ছিল না। ভেতরে পাওয়া যায় একটি বাইবেল, দুটি ডিকশনারি, কিছু বৈদ্যুতিক তার আর একটি ইলেকট্রিক শেভার।

আসলে তার এই কর্মকান্ড সবটাই ছিল প্রতীকী ভয়। সবটাই ছিল এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর জন্য ২০ টন ওষুধ পাঠানোর এক নব উদ্দীপনা।

সাত ঘণ্টার বেশি সময় পর দীর্ঘ আলোচনার শেষে বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে ফরাসি সরকার সীমিতভাবে তার দাবি মেনে নেয়। ফরাসি রেডক্রস ও অন্য একটি সংস্থার সহায়তায় দ্রুত সংগ্রহ করা হয় ১ টন জরুরি ওষুধ, যা পিআইএ বিমানে তোলা হয়।

এরপর ওষুধ আনার নামে দ্বিতীয় একটি ট্রাক বিমানটির কাছে আসে। চালক ও কর্মীদের বেশে ছিলেন পুলিশের ছদ্মবেশী সদস্যরা। ককপিটে ঢুকেই তারা জ্যঁ ক্যুয়েকে কাবু করে গ্রেপ্তার করে।

বিমান ছিনতাইয়ের অভিযোগে জ্যঁ ক্যুয়ের বিচার হয় এবং তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ইউরোপজুড়ে মানবাধিকারকর্মীদের আন্দোলনের মুখে ১৯৭৩ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এই ঘটনার পর ফ্রান্স নৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়- বাংলাদেশকে সাহায্য করতেই হবে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রেডক্রসের মাধ্যমে- ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানো হয় শরণার্থীদের কাছে।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে  জাতিসংঘে পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থাকে।

১৯৪৩ সালের ৫ জানুয়ারি আলজেরিয়ার মিলিয়ানা শহরে জন্ম নেওয়া জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে ছিলেন একজন সামরিক পরিবারের সন্তান। নিজেও ছিলেন ফরাসি সেনা। কিন্তু যুদ্ধ তাকে অস্ত্র নয়, মানবতার পথ দেখিয়েছিল। এই বিপ্লবী সেনা ২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

তিনি কখনো নিজেকে নায়ক বলেননি। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি থেকে গেছেন একজন বিদেশি বন্ধু, একজন মানবতার সৈনিক, একজন নেপথ্য মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।

একটি বিমানবন্দর থামিয়ে দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন- মানবতার পক্ষে দাঁড়ালে একা মানুষও ইতিহাস বদলে দিতে পারে।

Link copied!