একটি জাতির উন্নতির জন্য যেমন প্রয়োজন অর্থনৈতিক অগ্রগতি, তেমনি অপরিহার্য হলো একটি সুবিন্যস্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও জনমুখী শাসনব্যবস্থা। আমাদের দেশ বাংলাদেশ বহু আন্দোলন, সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের পথ বেয়ে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে পরিণত হলেও, এখনো রাষ্ট্র কাঠামোতে বিরাজ করছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং নৈতিক দেউলিয়াত্ব। এই জটিল বাস্তবতায়, একটি নতুন রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা, একটি প্রাতিষ্ঠানিক দিকনির্দেশনার প্রয়োজনীয়তা দিনে দিনে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই প্রয়োজন মেটাতে যে দর্শনটি প্রাসঙ্গিক, তা হলো- অ্যাপ্লাইড ডেমোক্রেটিক দর্শন এবং এর অন্তর্ভুক্ত এক অভিনব শাসনমডেল, ক্রেনিয়ামশিপ ডেমোক্রেসি।
অ্যাপ্লাইড ডেমোক্রেটিক দর্শনের মৌল ধারণা
প্রথাগত গণতন্ত্র অনেক সময়ই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হয়ে পড়ে, যেখানে ন্যায়ের বদলে সংখ্যার জোরই শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে রাজনীতিকদের ব্যক্তিস্বার্থ, অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা মিলে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বারবার ভেঙে পড়েছে। অথচ গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ হচ্ছে জবাবদিহিতামূলক ন্যায়শাসন, যেখানে জনগণের অধিকার রক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা হবে। এই লক্ষ্যে অ্যাপ্লাইড ডেমোক্রেটিক দর্শন প্রস্তাব করে এমন এক গণতান্ত্রিক মডেল, যা বাস্তবভিত্তিক, নীতিনিষ্ঠ ও সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী। এই দর্শনের মূল প্রস্তাব হলো- গণতন্ত্র শুধু একটি পদ্ধতি নয়, এটি একটি অন্তর্নিহিত নৈতিক দায়িত্বসম্পন্ন ব্যবস্থা যা আইন, জ্ঞান ও মানবিক বিচারের ওপর ভিত্তি করে গঠিত।
ক্রেনিয়ামশিপ ডেমোক্রেসি(নেতৃত্বের নবজাগরণ)
ক্রেনিয়ামশিপ ডেমোক্রেসি হচ্ছে অ্যাপ্লাইড ডেমোক্রেসির কেন্দ্রীয় কনসেপ্ট, যেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এক অরাজনৈতিক, নীতিনিষ্ঠ, প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের ওপর-যিনি জনগণের শাসন ভার গ্রহণ করেন না, বরং সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর সার্বিক তত্ত্বাবধানমূলক দায়িত্ব পালন করেন।
এই ক্রেনিয়াম ব্যক্তি হবেন নির্বাচিত রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদে দায়িত্বপ্রাপ্ত, যিনি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে সমস্ত রাজনৈতিক সংকটের গঠনমূলক সমাধান প্রদান করবেন। তার ভূমিকা হবে রাষ্ট্রের নৈতিক দিকনির্দেশক এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের সময় জাতির অভিভাবক। যেন গ্রীসের দর্শনের আদলে এক ‘দার্শনিক রাজা’র আধুনিক রূপ।
নতুন রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তের প্রস্তাবনা
১. সাংবিধানিক সংস্কার ও নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা : বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে আরও সুনির্দিষ্ট, জবাবদিহিতামূলক ও জনগণের নিকট দায়বদ্ধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি সর্বদলীয় সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং আধুনিক আইনের আলোকে গণতন্ত্রকে নতুন আঙ্গিকে বিন্যস্ত করা।
২. শতবর্ষীয় রাষ্ট্র কর্মপরিকল্পনা: জাতীয় উন্নয়ন কেবল পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ থাকলে তা স্বল্পদর্শিতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি কল্যাণ রাষ্ট্র নির্মাণে প্রয়োজন শতবর্ষভিত্তিক দফাভিত্তিক রাজনৈতিক রোডম্যাপ, যাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ সব বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে।
রাষ্ট্রের মূল্যায়ন সূচক
 নতুন রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তের বাস্তবায়ন অনুপাত অনুযায়ী রাষ্ট্রকে নিম্নরূপ শ্রেণিবিন্যাস করা যায়-
৭৫%-১০০% বাস্তবায়ন : আদর্শ রাষ্ট্র
৫০%-৭৪% বাস্তবায়ন : কল্যাণ রাষ্ট্র
৫০%-এর কম বাস্তবায়ন : অব্যবস্থা রাষ্ট্র
যদি রাষ্ট্র অব্যবস্থায় রূপ নেয়, তবে রক্তপাত ও গৃহবিপ্লব রোধে ক্রেনিয়াম তত্ত্বাবধানে সরকার ভেঙে একটি নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন হবে।
এখন সময় এসেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় চিন্তাকে সংস্কার করার, ব্যর্থ নেতৃত্ব ও জনবিচ্ছিন্ন শাসনব্যবস্থা থেকে সরে এসে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও যুগোপযোগী রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার। অ্যাপ্লাইড ডেমোক্রেটিক দর্শন ও ক্রেনিয়ামশিপ ডেমোক্রেসি সে দিকেই এক প্রত্যয়ী পদক্ষেপ।
একটি ঔষধি বৃক্ষ যেমন অরণ্যে লুকিয়ে থাকে, তেমনি একটি সুস্থ রাষ্ট্রব্যবস্থার গঠনমূলক চাবিকাঠিও লুকিয়ে থাকে সঠিক চিন্তা ও জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্বে। আমাদের কর্তব্য, সেই নেতৃত্বকে খুঁজে বের করা, তার অনুসরণে এগিয়ে যাওয়া। কেননা, আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম কোনো রাজনৈতিক দলের একক কর্তব্য নয়, এটি গোটা জাতির সম্মিলিত দায়।

 
                             
                                    

 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন