এটাই এখন যেন জাতীয় স্লোগান। কেউ কাউকে ভালো বলছে না। বিএনপি বলছে আওয়ামী লীগ ভয়ংকর। আওয়ামী লীগ বলছে বিএনপি খারাপ। জামায়াত বলছে, ওরা ধর্মহীন, আর নতুন রাজনীতিকরা বলছে, ‘পুরোনোরা সব চোর’। গণমাধ্যমও বিভক্ত- কেউ কারো ভালো দেখে না। অথচ প্রত্যেকেই চায় দেশ ভালো থাকুক। কিন্তু দেশ কি দল দিয়ে চলে? না চলে নীতির ওপর। আর এই নীতির সংকট আজ আমাদের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। আমরা মুখে ভালো মানুষ খুঁজি, কিন্তু কাজে শুধু নিজের স্বার্থ দেখি। এখন প্রশ্ন- ভালো কে?
প্রশ্ন যখন মৌলিক, উত্তরও মৌলিক হওয়া উচিত। তাই চলুন দেখি- এই ‘ভালো’র পেছনে কী লুকিয়ে আছে। বিশ্লেষণ করি ১৭টি বিষয়ে, যেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের ‘ভালো না-থাকার’ কারণ খুঁজে পাব।
১.দল নয়, ভালো হোক নীতি
একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি দল নয়, আদর্শ। কিন্তু আমরা আজ দলনির্ভর রাষ্ট্র বানিয়েছি। একটি দল ক্ষমতায় থাকলেই তাদের সব অপরাধ বৈধ হয়ে যায়, আর বিরোধী দল মানেই সব অপরাধের উৎস। এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। ভালো মানুষ হলে সে যে দলেই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের সম্পদ। আমাদের দরকার এমন রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে নীতির বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে না পারে। আমরা যদি সত্যিকারের ভালো মানুষদের তুলে ধরতে না পারি, তবে যত উন্নয়নের গল্পই বলি না কেন, জাতি পিছিয়ে পড়বে।
২. ‘ভালো’ মানেই কি আপনার দলের লোক না!
আমরা আজ এমন সমাজে বাস করি যেখানে দলীয় পরিচয়ই কাউকে ভালো বা খারাপ বানিয়ে দেয়। একজন মানুষ মানবিক, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হলেও যদি সে আপনার দলের না হয়, তাহলে আপনি তাকে ‘ভালো’ বলবেন না। এটাই আমাদের মনের সংকীর্ণতা। একজন সৎ মানুষ, একজন সমাজসেবক বা একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক যদি অন্যদলের হয়, তাকে ছোট করে দেখা জাতীয় আত্মঘাত। ভালো হওয়া মানে নৈতিক শক্তির অধিকারী হওয়া। দলীয় ট্যাগের ওপর নির্ভরশীল হওয়া নয়।
৩. নিজের স্বার্থ আগে দিলে কেউই ভালো না
নিজের পকেট, নিজের ঘর আর নিজের পরিবারকে আগে রেখে দেশের কথা বলা এক ধরনের প্রতারণা। আমরা রাজনীতিকে এমন জায়গায় নামিয়ে এনেছি যেখানে প্রথমেই আসে পদ-পদবি, চুক্তি, প্রজেক্ট, বিদেশ সফর। তারপর আসে জনগণ। যারা সবকিছু দেশের নামে শুরু করে নিজের নামে শেষ করে, তারা কখনো ভালো হতে পারে না। ভালো মানুষ সেই, যে নিজের কষ্ট মেনে নিয়ে অন্যের কল্যাণে কাজ করে।
৪. নেতারা আয়নাবিহীন, আত্মসমালোচনাহীন
কেউ নিজের ভুল স্বীকার করে না। কেউ ভাবে না ‘আমি কি ভুল করছি?’ বরং ভাবছে ‘লোকজন যদি না বোঝে, তাহলে সমস্যা নেই!’ অথচ সভ্য জাতি তখনই গড়ে উঠে, যখন নেতৃত্বে থাকা মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখে। নিজের ভুল শোধরানো নেতৃত্বের গুণ, দুর্বলতা নয়। একমাত্র আত্মসমালোচনা থেকেই জন্ম নেয় জবাবদিহি এবং জবাবদিহিই ভালো রাজনীতির মূল স্তম্ভ।
৫. গালি দেওয়া আর সমালোচনা এক নয়
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এখন গালিকেই সমালোচনা ভাবছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ প্রশ্ন তুললেই তাকে ‘শত্রু’, ‘রাজাকার’ বা ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমেই তো সংশোধন হয়। গালি দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করতে শিখলে সমাজে একটা পরিশীলিত রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হবে। যেখানে ‘ভালো’ মানে হবে- ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা।
৬. ‘আমার দলের চোরও ভালো’ মানসিকতা মারাত্মক
এমন মানসিকতা এখন সাধারণ জনগণের মাঝেও গেঁথে গেছে। কোনো নেতা চুরি করলেও যদি সে আমার দলের হয়, তাহলে সে ‘স্মার্ট’, ‘চালাক’। এটা এক ধরনের নৈতিক ব্যাধি। আমরা যদি চোরকে চোর বলতে না পারি, তাহলে আমাদের ঘরেও আগুন লাগবে। ভালো মানুষ হওয়া মানে হলো অন্যায়কে যেখানেই হোক- নিষ্পেষণ করা। দল দিয়ে নৈতিকতা বিচার করলে সমাজ পচে যায়।
৭. দেশের স্বার্থে সংলাপ নয়, সংঘাতই ভালো?
রাজনীতির প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, একে অপরের সঙ্গে বসাও সম্ভব না। এক টেবিলে বসতে চাওয়া মানেই দুর্বলতা, এমন মানসিকতা রাজনীতিকে গলি পর্যন্ত নামিয়ে এনেছে। আলোচনার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে না পারলে এই দেশে কখনোই ভালো কিছু গড়ে উঠবে না।
৮. নতুন মুখ মানেই ভালো?
নতুন মানেই সৎ নয়। পুরোনোদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ হয়ে আমরা নতুনদের ওপর আস্থা রাখি। কিন্তু যদি সেই নতুনরা পুরোনোদের মতোই সুবিধাভোগী হয়, তবে সেটা কেবল মুখোশ পরিবর্তনের নামান্তর। তাই নতুনের চেয়ে প্রাধান্য দিতে হবে নীতিকে, আদর্শকে, সততাকে।
৯. ধর্ম দিয়ে ভালো মাপা- প্রতারণার পথ
ধর্মের চেহারা নয়, আচরণই আসল পরিচয়। রাজনীতিতে ধর্মীয় আবরণ ব্যবহার করে মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করাই এখন কৌশল। কেউ টুপি পরে বক্তৃতা দিলে আমরা ধরে নেই সে পবিত্র। অথচ সে-ই হতে পারে সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধী। ভালো মানুষ ধর্মে নয়, কর্মে পরিমাপ করতে হবে।
১০. রাজনীতি মানেই চক্রান্তের মাঠ?
পদ, ক্ষমতা, ভোট, মনোনয়ন- সব কিছুতেই এখন চক্রান্ত। গোপনে ক্যাম্পেইন, মিডিয়া কিনে ফেলা, প্রভাব খাটানো, ব্ল্যাকমেইলিং- এসব যেন রাজনৈতিক সফলতার মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ‘পেছনের দরজা’ বন্ধ না হলে রাজনীতির নামে অপরাধ বাড়তেই থাকবে। ভালো রাজনীতি গড়তে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
১১. জনগণের মুখ বন্ধ, তাই কিছুই বদলায় না
আমরা বলি ‘সবই খারাপ’, কিন্তু কেউ রাস্তায় নামি না। কেউ কলম ধরে না। আমরা চুপ থাকি, কারণ আমরা ভয় পাই। অথচ ভয় যত বেশি, অন্যায় ততই বাড়ে। সৎ প্রতিবাদ না করলে কোনো সমাজ উন্নত হতে পারে না। তাই ভালো সমাজ চাইলে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।
১২. মিডিয়া যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, সত্য চাপা পড়ে
মিডিয়ার কাজ সত্য বলা। কিন্তু এখন সেটা হয়ে গেছে দলীয় প্রচারের মঞ্চ। ফলে সাধারণ মানুষ সত্য জানতে পারছে না। একটি জাতিকে অন্ধ করে রাখার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো- তথ্য লুকানো। মিডিয়া যদি নিরপেক্ষ না হয়, ভালো সমাজ কখনোই তৈরি হবে না।
১৩. সুশীল সমাজের নীরবতা অদ্ভুত রকমের ভালো না
যাদের সবচেয়ে আগে কথা বলা উচিত, তারা চুপ। তারা চুপ থাকে, কারণ সুবিধা হারাবে। এই নীরবতা আমাদের ভালো থাকার বড় বাধা। সুশীল সমাজ জেগে উঠলে ভালো আর মন্দ আলাদা করা সহজ হয়। কিন্তু তারা যদি চুপ থাকে, তাহলে নৈতিকতা হারিয়ে যায়।
১৪. উন্নয়নের নামে প্রতারণা এখনকার ট্রেন্ড
দুর্নীতির টাকা দিয়ে উন্নয়নের গল্প তৈরি করা যায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি হাসপাতাল থাকে কিন্তু ওষুধ না থাকে, স্কুল থাকে কিন্তু শিক্ষক না থাকে, সেতু থাকে কিন্তু টোল দিয়ে চলা যায় না- তাহলে এই উন্নয়নের কোনো মানে নেই। প্রকৃত উন্নয়ন হলো মানুষের জীবনে পরিবর্তন।
১৫. ভোট মানেই জীবন-মৃত্যু!
ভোট যেন জনগণের উৎসব নয়, নেতাদের যুদ্ধ। কাকে টেনে নামানো যাবে, কার কর্মীকে বেশি মারা যাবে- এটাই যেন টার্গেট। অথচ একটি সচেতন ভোটই জাতির ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিতে পারে। ভোট যেন সহিংসতামুক্ত হয়- সেটাই ভালো রাজনীতির প্রথম শর্ত।
১৬. ভালোকে ভালো বলা শিখে ফেলুন
আমরা এমন এক মানসিকতার শিকার- যেখানে ভালোকে ভালো বলা মানেই দল বদল! অথচ প্রশংসা করতে জানতে হয়। আপনার বিরোধী দলের কেউ ভালো কাজ করলে তাকে প্রশংসা করুন। এতে আপনি ছোট হবেন না, বরং মানুষ আপনাকে একজন মানবিক ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ভাববে। এটা সমাজে নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাবে।
১৭. আল্লাহর ফেরেশতা কি সত্যিই দরকার এ দেশে?
আল্লাহ ফেরেশতা পাঠাবেন না, পাঠাবেন আমাদেরই মধ্য থেকে কাউকে- যদি আমরা তৈরি হতে পারি। আমাদের দরকার একজন সৎ, সাহসী ও সত্যবাদী নেতৃত্ব, যে নিজের স্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থকে আগে রাখবে। একজন মানুষই একটি জাতিকে বদলে দিতে পারে- যদি সে ফেরেশতার মতো মন নিয়ে এগিয়ে আসে।
শেষ কথা সবাই অন্যকে দোষ দেয়, কিন্তু নিজের ভুল স্বীকার করে না। এই দেশ যদি সত্যি ভালো হতে চায়, তাহলে নেতাদের আগে জনগণকেই ভালো হতে হবে। সততা, মানবতা ও দেশপ্রেমে জেগে উঠতে হবে। দল নয়- দেশ আগে ভাবতে হবে। ভালোকে ভালো বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর সে জন্য ফেরেশতা দরকার নয়, দরকার ফেরেশতার মতো একজন সৎ মানুষ, যিনি নিজের স্বার্থ নয়- দেখবেন দেশের স্বার্থ। ভালো কে? আপনি- যদি আপনি নিজেকে বদলাতে পারেন।

 
                             
                                    

-20250731173425.webp)
 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন