ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ড ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং একযোগে পাকিস্তানের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠতা এশিয়া অঞ্চলে নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। এই দ্বিমুখী কৌশল শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বরং চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
একদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। ফলে মোট শুল্কের হার দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে, যা এখন পর্যন্ত বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সিদ্ধান্ত বিশ্লেষকদের জন্য চমক হয়ে এসেছে, বিশেষ করে যেহেতু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ছিল কৌশলগত অংশীদার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে অপরকে প্রকাশ্যে ‘বন্ধু’ বলেও সম্বোধন করেছিলেন।
বাণিজ্য আলোচনায় অচলাবস্থা
২০২৪ সালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ভারতের পক্ষে। মোদি জানিয়েছিলেন, তিনি আগামী পাঁচ বছরে এই বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চান।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, শুল্ক আলোচনা চলাকালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পপণ্যের ওপর কর তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল এবং প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি কেনাকাটাও বাড়াতে রাজি হয়েছিল। তবে কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর শুল্ক তুলতে ভারত অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কারণ, এই খাতগুলোতে কোটি কোটি দরিদ্র ভারতীয় নাগরিকের জীবিকা জড়িত এবং রাজনৈতিকভাবে এটি অতি সংবেদনশীল বিষয়।
ভারতের ওপর মার্কিন চাপ
এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশন অব কানাডার ভিনা নাজিবুল্লাহ বলেন, ‘এটি দুই দেশের সম্পর্কের সবচেয়ে খারাপ সময়। এখন ভারত এমন একটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, যারা কোনো চুক্তি ছাড়াই সবচেয়ে বেশি শুল্কের শিকার হয়েছে।’
নিউইয়র্কে অবস্থিত এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ এশিয়া ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ফরওয়া আমের বলেন, এই বাণিজ্য বিরোধ কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং এর গভীরে রয়েছে ভূরাজনৈতিক পার্থক্য। তিনি উল্লেখ করেন, মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় ট্রাম্প দাবি করেছিলেন তিনি যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছেন, যা ভারত দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে।
অন্যদিকে পাকিস্তান ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে মনোনয়নের ঘোষণা দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ অনুসন্ধান ও জ্বালানি চুক্তির পথেও এগিয়ে যায়। চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক মৈত্রী থাকা সত্ত্বেও, এই পরিবর্তন পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন মাত্রা প্রকাশ করছে।
আমের বলেন, ‘ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ও শক্তিশালী অবস্থান তার পররাষ্ট্রনীতির চালিকাশক্তি।’ তার মতে, ভারতের নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখেও মোদি আপস করতে নারাজ।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ রবার্ট রোগোস্কি বলেন, ‘মোদির মতো নেতার ওপর চাপ প্রয়োগ করলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া আসবে। খুব শিগগিরই নতুন কূটনৈতিক পথে যেতে পারে দুই দেশ।’
চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক
এই প্রেক্ষাপটে চীন নিজেও সতর্ক। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির সম্প্রতি চীন সফর করেন, এর আগে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রে। এই ২ মাসের ব্যবধানে আবারও যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন আসিম মুনির। চলতি সপ্তাহেই তিনি দেশটিতে সফর করবেন। তার সফরের ফলাফল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে একটি নতুন মোড় আনছে বলে দাবি করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট।
চীনের দক্ষিণ এশিয়া গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হু শিসেং বলেন, ‘পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়লেও, তা কখনো চীনের বিনিময়ে নয়। পাকিস্তান এত সহজে ট্রাম্পের ফাঁদে পড়বে না।’
চীনা গবেষক জেসি ওয়াং আরও বলেন, ‘ট্রাম্পের প্রস্তাব দেখতে ভালো লাগলেও, তা চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের গঠনগত ভিত্তিকে নষ্ট করতে পারবে না। কারণ, পাকিস্তান চীনের ওপর নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগতভাবে নির্ভরশীল।’
ওয়াং আরও বলেন, ‘এই সম্পর্ক অ্যালয় স্টিলের মতো শক্ত, বাইরের চাপ এটি আরও শক্তিশালী করে। ট্রাম্পের ওয়েজ স্ট্র্যাটেজি (বিভাজনের কৌশল) পাকিস্তানের ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলের সামনে পরাজিত হবে।’
চীনের দৃষ্টিভঙ্গি
চীন বিশ্বাস করে, পাকিস্তান তার কৌশলগত স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করলেও, চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক গঠনমূলক ও পরীক্ষিত। হু শিসেং বলেন, ‘ট্রাম্প আশা করছেন পাকিস্তান চীনের প্রভাব থেকে সরে যাবে, কিন্তু বাস্তবে তা হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের চোখে পাকিস্তানের গুরুত্ব চীনের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত।’
চীনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া কৌশল এখনো রূপান্তরের মধ্যে আছে। ভারতের ওপর শুল্ক আরোপ করা মানে এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করছে। বরং ভারতের ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’র প্রতি ট্রাম্প যে হতাশ হয়েছেন, এটি তা-ই প্রকাশ করে।
জেসি ওয়াং বলেন, ‘ট্রাম্প কৌশলগত পারস্পরিকতার নীতি থেকে সরে গিয়ে কেবল নিজের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। এ কারণে ভারত হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করবে।’
আঞ্চলিক প্রভাব ও ভারতের বিকল্প কৌশল
বর্তমানে ভারত যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির দিকে ঝুঁকছে। চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিচ্ছে। মোদি চলতি মাসে সাংহাই কো-অপারেশন অরগানাইজেশন (সিএসও) সম্মেলনে যোগ দিতে চীন সফরে যেতে পারেন। এটি হবে ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীন সেনা সংঘর্ষের পর তার প্রথম চীন সফর।
তবে, এর আগেই প্রায় পাঁচ বছর পর গত মাসে (জুলাই) চীন সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। গালওয়ান সংঘর্ষের পর এই প্রথমবার উচ্চপর্যায়ের সাক্ষাৎ হয় দুদেশের মধ্যে।
২০২০ সালের জুন মাসে গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ভারতের ২০ সেনা সদস্য নিহত হন। এরপর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমশ শীতল হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিন পর এই উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে এই সময়ে ট্রাম্পের শুল্ক-নীতি ভারতের উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপল ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির জন্য সব আইফোনের যন্ত্রাংশ ভারতে সংযুক্ত করা হবে। কিন্তু ৫০ শতাংশ শুল্কের দেশের সঙ্গে ব্যবসা করা কোম্পানিগুলোর জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
ভিনা নাজিবুল্লাহ বলেন, ‘এই শুল্ক সিদ্ধান্ত শুধু অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তাই বাড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা আগেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। এখন তা আরও প্রকট হচ্ছে।’
সবদিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের নতুন কৌশল একদিকে ভারতকে চাপে ফেলছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে—যা চীনের জন্যও চ্যালেঞ্জ। চীন মনে করে, এর ফলে তাকে আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনাকে আরও জোরদার করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন ভারতের সামনে বড় প্রশ্ন হলো—তারা কি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখবে, নাকি চীনের সঙ্গে সমঝোতার পথে এগোবে?
বিশ্বরাজনীতির বর্তমান বাস্তবতায়, কেবল কূটনৈতিক চালাকি নয়, প্রয়োজন বাস্তববাদ ও কৌশলগত ভারসাম্য। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ভূরাজনীতির এই অধ্যায়ে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—তিন পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য তৈরিই আগামী দিনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ।