দেশপ্রেম থাকলে, উদ্দেশ্য স্বচ্ছ হলে ভালো উদ্যোগ নিতে আইন-বিধি, প্রথা কোনো বাধা হয় না। যার এক জলন্ত নজির তৈরি করেছে কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাস। প্রবাসীদের অধিকার সুরক্ষায় সেখানে নেয়া হয়েছে তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ। ফলও মিলতে শুরু করেছে। যার মধ্যে ভিসা সত্যায়ন প্রক্রিয়া অন্যতম। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কুয়েতে আসার আগে কর্মীদের নিয়োগকর্তার সত্যতা যাচাই করা হয়, যা দালালদের দৌরাত্ম্য বরবাদ করে দিয়েছে। কাউকে মারতে-ধরতে হয়নি। দূতাবাসের এ পদক্ষেপ প্রবাসীদের জন্য প্রক্রিয়াগতভাবেই আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। দূতাবাসের এ উদ্যোগ প্রবাসীদের নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষায় একটি মাইল ফলক।
কুয়েতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল সৈয়দ তারেক হোসেনের কিছু সময়ের পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা, আন্তরিকতা সর্বোপরি বাস্তবতা উপলব্ধির জেরেই এমন উদ্যোগ। এর সুবাদে কুয়েতে প্রবাসীরা প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন, যা এক সময় ছিল ধারনারও বাইরে। নিয়তির মতো ভাবতে হয়েছে প্রতারকদের যন্ত্রণাকে। সেখানে এখন বিপরীত চিত্র। এ আনন্দে ঈদ-ঈদ ভাব তাদের মাঝে। উদ্যোগটি কার্যকরের আগে কিছু হোম ওয়ার্ক শেষে কুয়েতস্থ দূতাবাসের প্রতিনিধিদল সংশ্লিষ্ট কোম্পানির চুক্তিপত্র, কর্মপরিবেশ, আবাসন ব্যবস্থা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন তিনি। এরপর দ্রুত কার্যকর করেন ব্যবস্থাটি।
এর আগে, দূতাবাসের এমন তদারকি ছিল না। এমন একটি ব্যবস্থার দাবি থাকলেও তা গ্রাহ্য করা হয়নি। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারো মাধ্যমে কুয়েত গিয়ে যন্ত্রণায় পড়া ছিল বিধিলিপির মতো। তা জেনেই রিজিকের খোঁজে মানুষ যেত কুয়েতে। যেই কোম্পানির ভিসা কিনে যেতেন সেখানকার নির্ধারিত কন্ট্রাক্ট শেষ মানে রেসিডেন্সি পারমিট শেষ। কর্মহীন হয়ে পুনরায় বাড়তি টাকায় অন্যত্র রেসিডেন্সি খোঁজা। রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল সৈয়দ তারেক হোসেন সেখানে যোগ করলেন নতুন বন্দোবস্ত।
তার সময়োপযোগী ও প্রবাসীবান্ধব এমন ব্যবস্থায় যারপরনাই মুগ্ধ কুয়েত প্রবাসীরা। বাংলাদেশ প্রেসক্লাব কুয়েত, বাংলাদেশ ক্রিকেট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ রিপোর্টার্স ইউনিটি ও টিভি জার্নালিস্ট এস্যোসিয়েশনের নেতারা ও বাংলাদেশ কমিউনিটির সচেতন প্রবাসীরা রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল সৈয়দ তারেক হোসেনের নেয়া উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা রাষ্ট্রদূতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এই ব্যবস্থাকে স্থায়ী করার আহ্বান জানিয়েছেন।
দূতাবাসেই ভিসা সত্যায়িত হওয়া, একদিকে যেমন কুয়েতে আগত নতুন প্রবাসীদের বছর দুয়েক অন্ততঃ কন্ট্রাক্ট থাকা অবস্থায় আকামা নিয়ে চিন্তামুক্ত থাকা। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বৈধ পথে কুয়েত গিয়ে অবৈধ হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া এক বিশাল প্রাপ্তি। এমন পদ্ধতি করায় এই সময়ে কোনো সমস্যা হলে কুয়েতের আইনানুযায়ী দূতাবাস সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এ ছাড়া জবাবদিহিতারও একটা পথ থাকবে। এটা শুধু দূতাবাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে সরকারিভাবে আইন করার পথ তৈরি হলো। কুয়েতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তী প্রশাসন ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন, পদ্ধতিটিকে যেন স্থায়ী করা হয়। বাস্তবায়ন করতে হবে আরও শক্তিশালীভাবে।
ভিসা সত্যায়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে কুয়েতে যাওয়ার আগেই নিয়োগকর্তার প্রকৃত অবস্থা যাচাই হয়ে যাবে। পদ্ধতিটিকে আইনে রূপ দিতে পারলে আরো অনেক সুবিধা মিলবে। তবে, পাশাপাশি জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্রদূতের এ উদ্যোগকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রবাসী সংগঠন ও নেতৃবৃন্দ প্রশংসা করে এই ব্যবস্থা স্থায়ী করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতারনায় ছেদ পড়ার কারণে ভিসা দালালচক্র এই ব্যবস্থাকে অবলুপ্ত করার চক্রান্ত শুরু করেছে। তারা একে বানচাল করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল সৈয়দ তারেক হোসেন এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক। এরপরও কথা থাকে। দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে দেয়ায় আক্রান্ত চক্রটিও শক্তিশালী। এর বিপরীতে একদল দক্ষ, একনিষ্ঠ কর্মচারী-কর্মকর্তা কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসী বাংলাদেশীদের অধিকার রক্ষা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিশ্চিতে বেশ তৎপর। তাদের কর্মতৎপরতা ও ভূমিকায় কুয়েতে ভিসা দালালদের সিন্ডিকেটে লাগাম পড়েছে। অনৈতিক রোজগারে বাজ পড়েছে। বর্তমানে যে কোন কোম্পানিকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনতে হলে অবশ্যই দূতাবাস কর্তৃক নির্ধারিত প্রবাসী শ্রমিক বান্ধব শর্ত নিশ্চিত করেই নিয়োগ দিতে হয়। ভিসা অনুমোদনের আগে সকল প্রতিষ্ঠানকে শ্রমিকের সঙ্গে কমপক্ষে দুই বছরের চুক্তি, নির্ধারিত বেতন কাঠামো এবং প্রবাসীদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা চুক্তিপত্রে সংক্রান্ত স্বাক্ষর করিয়ে নিতে হয়।
বর্তমানে নিয়োগকর্তাকে সরাসরি দূতাবাসে এসে শ্রমিকদের জন্য বেতন, ছুটি এবং ভাতার নিশ্চয়তা দিয়ে দিতে হচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে কোন ধরনের অবিচার বা প্রতারণা হলে তাকে আইনের আওতায় আনা যায়। একসময় কুয়েতে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা তেমনভাবে মানা হতো না। শুধু ভিসা পেলেই বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এই শিথিলতার সুযোগ নেয় দালালদের শক্তিশালী চক্র। দূতাবাসের ধারাবাহিক ও কঠোর পদক্ষেপে দিশাহারা হয়ে পড়েছে ভিসা দালাল চক্র। নানা কূটকৌশল ও অপপ্রচার চালিয়ে তারা দূতাবাসের শর্ত শিথিল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশ পাঠানোই ছিল তাদের ব্যবসা। রাষ্ট্রদূতের নেয়া পদক্ষেপে সেখানে এখন ভিন্নচিত্র। তার সুস্পষ্ট নির্দেশনায় এখন কোনো কোম্পানিকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে হলে অবশ্যই প্রবাসীবান্ধব নির্ধারিত শর্তাবলী মানতে হয়, যা দূতাবাস কঠোরভাবে তদারকি করছে। গৃহকর্মী নিয়োগেও আগে কোনো নির্ধারিত নিয়ম ছিল না। দূতাবাসের নজরদারিতে সম্প্রতি একটি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানটি ৩ থেকে ৬ মাসমেয়াদি ভিসায় শ্রমিক এনে তাদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত অবৈধভাবে আদায় করত।
এমন দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশ দূতাবাস এখন প্রবাসী সুরক্ষার বিষয়ে আপসহীন অবস্থানে রয়েছে। প্রবাসীদের সেবায় দূতাবাসের কর্মকর্তারা চালু করেছেন। তাদের নেয়া আরও কিছু প্রবাসীজনবান্ধব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে- প্রতিমাসে গণশুনানি এবং দূতাবাস কর্মকর্তাদের কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। দূতাবাস স্টাফদের নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করে পরিচয় নিশ্চিত করা। দালাল সনাক্ত করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠানো। ভিসা এবং পাসপোর্ট প্রক্রিয়ায় অধিকতর স্বচ্ছতা এবং গতিশীলতা নিশ্চিত করা। দূতাবাসের ফেসবুক পেইজ এবং ওয়েবসাইট হালনাগাদ করে তথ্যসেবা বাড়ানো। বাংলাদেশী কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সম্ভাব্য সকল তৎপরতা অব্যাহত করা রাখা। দূতাবাসের দুর্নীতি পরায়ণ ও অযোগ্য কর্মচারী কর্মকর্তাদের অব্যাহতি এবং যোগ্য জনবল নিয়োগ। মারা যাওয়া প্রবাসীদের দেহ সরকারি খরচে তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে দেশে পাঠানো নিশ্চিত করা। দূতাবাসের অভিযোগ বক্স এবং হটলাইন সার্বক্ষণিক চালু রাখা।
এসব উদ্যোগ কার্যকর হলে কুয়েত প্রবাসীরা কেবল লাভবান হবেন তা নয়। সেখানে দেশের ইমেজও বাড়বে। পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিবেচনায় অন্যান্য দেশেও কুয়েতে গড়া রাষ্ট্রদূতের এ মাইলস্টোনকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কল্যাণে পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তার দুয়ার খুললো। মেজর জেনারেল সৈয়দ তারেক হোসেন কুয়েতে প্রথম রাষ্ট্রদূত নন, শেষ রাষ্ট্রদূতও নন। তিনি যে দৃষ্টান্ত বা মাইলস্টোন গড়লেন এর ফলো আপ রক্ষা বিশেষভাবে কাম্য। সেইসঙ্গে অন্যান্য দেশে পরিবেশ ও বাস্তবতা দৃষ্টে বাংলাদেশি প্রবাসীবান্ধব পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রত্যাশিত। জেনারেল তারেক সেই রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেন।
আপনার মতামত লিখুন :