ঢাকা শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫

মতামত

সাদা পাথরের মৃত্যু: পর্যটন ও নৈতিকতার কালো অধ্যায়

মুনাওয়ার মইনুল 
প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৫, ০৯:২১ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

সিলেটনগরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো থেকে যে নদীর উৎপত্তি হয়ে ভোলাগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সেই নদীর নাম ধলাই নদ। পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানির স্রোতে এই নদী বেয়েই সাদা পাথর নেমে আসে। ধলাই নদের উৎসমুখের এই জায়গার নাম ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট। সিলেটের ধলাই নদীর তীরে অবস্থিত ‘সাদা পাথর’ বেশ কয়েক বছর ধরে ছিল বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট।

স্বচ্ছ পানিতে ভাসমান দুধ-সাদা শিলাখ-, পেছনে পাহাড়ের সবুজ আচ্ছাদন, আর আশপাশের শান্ত পরিবেশ, সব মিলিয়ে যেন এক স্বপ্নের দৃশ্য। ২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসত। শুধু সৌন্দর্য নয়, এই পাথরগুলো ছিল পরিবেশের জন্যও অপরিহার্য। নদীর স্রোত নিয়ন্ত্রণ, তীর ভাঙন রোধ, জলজ প্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণ, সব কিছুতেই এর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু সম্প্রতি যা ঘটেছে, তা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, বিশ্বেও বিরল। দিনের আলোতে হাজার হাজার মানুষ একযোগে এই সাদা পাথর তুলে নিয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে গেছে ভিডিও আর ছবিতে। পাথর বোঝাই নৌকা, ট্রাক, আর শত শত মানুষ কাঁধে বা মাথায় পাথর বহন করছে। অথচ প্রশাসন ছিল নীরব, আর স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এসেছে অন্তরালে ইন্ধন।

পাথরের গুরুত্ব : সৌন্দর্যের বাইরে পরিবেশ ও অর্থনীতিতে অবদান পাহাড়ি ঢলে প্রতি বছর ভারতের মেঘালয় থেকে ধলাই, পিয়াইন, সারি গোয়াইনসহ সিলেটের সীমান্তবর্তী নদীগুলোতে পাথর আসে। এই পাথর নদীর তলদেশকে মজবুত করে, অতিরিক্ত স্রোত ঠেকায়, আর তীর ভাঙন রোধ করে। এ ছাড়া এগুলো জলজ প্রাণীর বাস্তুসংস্থানের অংশ, যা মাছ ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও পাথরের ভূমিকা বিশাল। সাদা পাথর এলাকায় পর্যটন শিল্প স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থানের বড় উৎস ছিল। নৌকাচালক, দোকানি, গাইড, ফটোগ্রাফার, হোটেল ও রিসোর্টকর্মী, প্রায় ৫-৬ হাজার মানুষ সরাসরি জীবিকা নির্বাহ করত। শীত মৌসুমে প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক আসত, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে দিনে কয়েক কোটি টাকা প্রবাহিত করত।

লুটপাট : কীভাবে ঘটল?

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয় পাথর উত্তোলন। প্রথমে ছোট পরিসরে হলেও, কয়েক মাসের মধ্যে তা ভয়াবহ আকার নেয়। গত ১০ মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সমমূল্যের পাথর অবৈধভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর হিসাব। শুধু শেষ ১৫ দিনেই লুটের মাত্রা নজিরবিহীন হয়ে ওঠে। একটি ইংরেজি গণমাধ্যম জানাচ্ছে, সরকার পতনের প্রথম ৩ দিনে জাফলং-সাদা পাথর থেকে প্রায় ২০১ কোটি টাকা মূল্যের পাথর চুরির ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে সাদা পাথর থেকে ২০ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২৪ এপ্রিল থেকে সাদা পাথর এলাকা থেকেই পাথর উত্তোলন শুরু, হাজার হাজার শ্রমিক দিনের বেলায় কাজ করছে- বিরামহীনভাবে গর্ত তৈরি করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এই লুটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রায় সব রাজনৈতিক পক্ষের নাম এসেছে। কিছু সিন্ডিকেট পুরো এলাকা ভাগ করে নিয়েছিল, যাতে কেউ কারো কাজের মধ্যে হস্তক্ষেপ না করে। এক নেতা এই ঘটনায় অভিযুক্ত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় কমিটি তাকে পদচ্যুত করে। কিন্তু সেই পদক্ষেপে বাস্তবিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, ‘রেইড চলছে, দায়ীদের মোবাইল কোর্টে ২ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে; প্রয়োজনে কঠোরতাও বাড়ানো হবে।’

প্রশাসনের ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক ইন্ধন

যখন ভিডিও প্রমাণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলো, তখন প্রশাসন কয়েকটি অভিযান চালাল। কিন্তু কোনো বড় সিন্ডিকেট লিডারকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, অভিযান চলছে, কিন্তু নদীর বুকে প্রতিদিনের লুট বন্ধ করতে স্থায়ী সমাধান দরকার। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এই ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এটি কেবল প্রশাসনের ব্যর্থতা নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিরও ভঙ্গ। আমরা প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে চাই বলে ঘোষণা দিই, আর বাস্তবে দিনের আলোতে তা ধ্বংস হতে দিই।’ বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘গত ১০ মাসে যা ঘটেছে, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত মাত্রার লুট। স্থানীয় প্রশাসন পুরোপুরি ব্যর্থ।’

সামগ্রিকভাবে ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে দেশের হাল ধরার সংকল্প যা আমরা দেখেছিলাম জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সংলাপে, তার বৈপরীত্য এই পাথর লুটের ক্ষেত্রে দেখা  গেল।

বাস্তবিক অর্থে এই লুটপাট ঠেকানোতে রাজনৈতিক দলের কাউকেই  অগ্রণী ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি, যা সত্যিকার অর্থে হতাশাজনক। যারা ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনা করবেন, দেশের সব সম্পদ এবং দেশ যাদের হাতে থাকবে বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, সেই রাজনৈতিক দলগুলো ছিল উদাসীন বরং অনেকেই এই ঘটনার সঙ্গে আছেন বলে স্থানীয়রা বলছেন। 

ক্ষতির পরিমাণ : অর্থ, পরিবেশ ও পর্যটন

অর্থনৈতিক ক্ষতি শুধু পাথরের বাজারমূল্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী।

আর্থিক ক্ষতি : শুধু সাদা পাথর থেকেই ‘গত ১০ মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সমমূল্যের পাথর লুট হয়েছে’- স্থানীয় সূত্র ও পরিবেশ কর্মীরা জানিয়েছেন।

পর্যটন খাত : পর্যটকরা আগ্রহ হারাচ্ছে, হোটেল-রিসোর্টে বুকিং কমছে, স্থানীয় ব্যবসা ধসে পড়ছে।

পরিবেশ : নদীর তলদেশে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বর্ষায় বন্যার আশঙ্কা বাড়ছে, মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর আবাস ধ্বংস হচ্ছে।

সামাজিক : মানুষ দেখেছে, আইন ভেঙে ধরা না পড়াই স্বাভাবিক, যা নৈতিক অবক্ষয়কে আরও গভীর করছে। একটি লুটেরা মানসিকতা ভয়াবহ আকারে মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এই লুট-সংস্কৃতি ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।

মনস্তত্ত্ব : কেন এমন হলো?

এ ঘটনা দেখায়, স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করি না। কয়েকশ বা কয়েক হাজার টাকার পাথর বিক্রির জন্য একটি পুরো ইকোসিস্টেম ধ্বংস করে দেওয়া, এ এক ধরনের আত্মঘাতী মনস্তত্ত্ব। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়, আইনের শিথিলতা, আর জনগণের পরিবেশ সচেতনতার অভাব।

করণীয় : এখনই না হলে আর কখনো নয়

১. আইনি সুরক্ষা : সাদা পাথর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ‘ঊপড়ষড়মরপধষষু ঈৎরঃরপধষ অৎবধ’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।

২. শক্তিশালী আইন প্রয়োগ : বালু ও পাথর উত্তোলন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১০ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।

৩. রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা : সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

৪. জনসচেতনতা : স্থানীয়দের পর্যটনভিত্তিক জীবিকা গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় স্বার্থান্বেষী হয়।

৫. টেকসই পর্যটন পরিকল্পনা : পর্যটন আয় থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন ফান্ডে রাখতে হবে।

টাকা, পাথর আর পলিটিক্সের মিশেলে ‘সাদা পাথর’- একসময় পর্যটনের মুকুট, আজ হয়েছে বরবাদ ও গণতন্ত্রের নিঃস্ব স্মারক। এই ঘটনা শুধুই পাথর লুট নয়, এটা প্রমাণ করে রাজনৈতিক সহযোগিতা আর প্রশাসনিক অসহায়তা কীভাবে একটি সম্পদকে রূপহীন করে ফেলে। সাদা পাথরের লুট শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষতি নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয়েরও প্রতিচ্ছবি।

আমরা যদি এখনই শিক্ষা না নিই, তবে ভবিষ্যতে জাফলং, বিছানাকান্দি, রাতারগুলের মতো স্পটও একই পরিণতির মুখোমুখি হবে। প্রকৃতি একবার ধ্বংস হলে তা ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। তাই দেশের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, এখনই এই ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে হবে, শক্ত হাতে, দৃঢ় সংকল্পে।