ঢাকা মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

বিশ্লেষণ

গাজায় পালাক্রমে সাংবাদিক হত্যা, মৃত্যুর অপেক্ষায় জীবিতরা

দ্য গার্ডিয়ান
প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২৫, ০৭:২৯ পিএম
ছবি- সংগৃহীত

দখলদার ‘ইসরায়েল’ বর্তমানে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দুটি আগ্রাসী অভিযান চালাচ্ছে—একটি গাজার সামরিক নিয়ন্ত্রণের জন্য, আরেকটি গাজায় কী হচ্ছে বিশ্বের কাছে সেই তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য।

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, গাজার অনাহার, গণহত্যা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের তথ্য সংগ্রহকারী ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টরা সুরক্ষিত বেসামরিক নাগরিক হিসেবে বিবেচিত।

তবে বাস্তবে গাজা বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গায় পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠতা তথা ‘জঙ্গি’ তমকা দিয়ে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে কট্টর জায়নবাদী ‘ইসরায়েল’।

কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ২২ মাসের যুদ্ধে ‘ইসরায়েলি’ আক্রমণের শিকার হয়েছে ১৮০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।

আইন অনুযায়ী সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করা বেআইনি হলেও সিপিজে বলছে, একই সময়ে অন্তত ২৬ জন সাংবাদিককে সরাসরি টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলোকে তারা ‘স্পষ্ট হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

সর্বশেষ ঘটনা ঘটে রোববার ২৮ বছর বয়সি আল-জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরিফ গাজা শহরের একটি হাসপাতালের বাইরে তার অস্থায়ী সংবাদকক্ষে চার সহকর্মীর সঙ্গে ‘ইসরায়েলি’ হামলায় নিহত হন। নিহতদের মরদেহ নিয়ে শোকার্তরা সড়কে মিছিল করেন।

প্রেস স্বাধীনতা সংগঠন ও সাংবাদিকদের মতে, গাজায় সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড মূলত ভীতি সৃষ্টির একটি অভিযানের অংশ, যার লক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন বা তথ্য প্রবাহ বন্ধ করা। ‘ইসরায়েল’ এ ধরনের হামলাকে আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায্যতা দিয়েছে মিথ্যা দাবি করে যে ‘নিহতরা গোপনে হামাস যোদ্ধা’ ছিলেন।

গাজায় আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের প্রবেশ ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগও কঠোরভাবে সীমিত। অল্প কয়েকজনকে ‘ইসরায়েলি’ সেনাদের পাহারায় ঢুকতে দেওয়া হলেও তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা বা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। ফলে গাজায় সাংবাদিকদের উপস্থিতি ও কাজ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সিপিজে-এর প্রধান নির্বাহী জোডি গিন্সবার্গ বলেন, “আমার কোনো সন্দেহ নেই আন্তর্জাতিক প্রবেশাধিকার রোধ, সাংবাদিকদের হত্যা, গণমাধ্যমের স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করা, এমনকি হারেৎজের মতো ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমকে শাস্তি দেওয়া সবই গাজার ভেতরে কী ঘটছে তা গোপন রাখার ইসরায়েলের পরিকল্পিত কৌশলের অংশ।”

তিনি উদাহরণ দেন সাম্প্রতিক এক ঘটনার, যখন বিবিসির একটি দল জর্ডান থেকে গাজায় মানবিক ত্রাণ পাঠানোর রিপোর্ট করছিল। ‘ইসরায়েল’ তাদের ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য ধারণ করতে বাধা দেয়। গিন্সবার্গ বলেন, ‘আমরা দেখেছি বিমান থেকে নামানো ত্রাণের ছবি তুলতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু দরজা খোলার সময় ধ্বংসযজ্ঞের ছবি তুলতে দেওয়া হয়নি।’

গত জুলাই মাসে গাজার অন্যতম পরিচিত সাংবাদিক শরীফ অনাহার পরিস্থিতি নিয়ে খবর করার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। পথচারীরা তাকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করেন, কারণ তিনি গাজার মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন।

কিছুদিন পরেই এক ‘ইসরায়েলি’ সামরিক মুখপাত্র ২০২৪ সালে করা অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, শরীফ আসলে একজন ‘জঙ্গি’ এবং তিনি ‘অনাহার নিয়ে মিথ্যা হামাস প্রচারণা’ চালাচ্ছেন।

সিপিজে সতর্ক করে জানায়, এই ধরনের অভিযোগ আসলে তাকে হত্যার জন্য সম্মতি তৈরির চেষ্টা। সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক সারা কুদাহ বলেন, ‘এটি প্রথমবার নয় যে ইসরায়েলি সেনারা শরীফকে টার্গেট করেছে, কিন্তু এখন তার জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি।’

শরীফ নিজেও মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি লেখেন, ‘যদি এই বার্তাটি তোমাদের কাছে পৌঁছায়, তাহলে বুঝবে ইসরায়েল আমাকে হত্যা করতে এবং আমার কণ্ঠ বন্ধ করতে সফল হয়েছে।’

পরে ‘ইসরায়েল’ গাজা থেকে উদ্ধার করা কিছু নথি প্রকাশ করে, যেখানে শরীফকে হামাসের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি করা হয়। তবে এসব নথিতে ২০২১ সালের পরের কোনো তথ্য নেই এবং ক্যামেরার সামনে তার নিয়মিত সাংবাদিকতার উপস্থিতি নিয়েও কিছু বলা হয়নি।

পৃথিবীর সবচেয়ে নজরদারিপূর্ণ অঞ্চলের একটিতে, তাও সর্বাত্মক যুদ্ধের সময়, গাজার একজন শীর্ষ সাংবাদিককে হামাস ইউনিটের কমান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা প্রায় অসম্ভব।

গত বছর আল-জাজিরার আরেক সাংবাদিক ইসমাইল আল-ঘৌলকে হত্যার পর ‘ইসরায়েল’ কর্তৃক প্রকাশিত নথিতে দাবি করা হয়, তিনি মাত্র ১০ বছর বয়সেই সামরিক পদমর্যাদা পেয়েছিলেন। এসব নথিতে পরস্পরবিরোধী ও অবিশ্বাস্য তথ্য থাকলেও তাদের অস্তিত্ব ইঙ্গিত দেয় যে ‘ইসরায়েল’ অন্তত পশ্চিমা মিত্রদের চাপ এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত।

তবে আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও ‘ইসরায়েল’ শরীফের সঙ্গে নিহত তার চার সহকর্মী কেন কর্মক্ষেত্রে টার্গেট হয়েছেন, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। সিপিজে প্রধান নির্বাহী জোডি গিন্সবার্গ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘এটি আসলে একটি সতর্কবার্তা, ভয়ংকর ঝুঁকি এখন আরও বেড়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে বিস্ময়ের বিষয় হলো তারা অন্য হত্যাকাণ্ডের ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টাও করেনি। অর্থাৎ তারা স্বীকার করছে যে, তারা সাংবাদিকদের হত্যা করেছে এবং জেনেশুনেই করেছে। এটি ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ভয়ংকর বার্তা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে, যাতে বোঝানো যায় ‘ইসরায়েল’ যাইচ্ছে তাই করতে পারে। কেউ কিছুই করবে না।’

গাজায় কর্মরত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েল যদি এভাবে প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে পারে, তাহলে গাজায় কর্মরত বাকি সাংবাদিকদের ভবিষ্যৎ কী? এরপর কার পালা আসবে?’

সম্প্রতি গবেষণার জন্য বিশেষ অনুমতি নিয়ে গাজায় গিয়েছিলেন ফরাসি ইতিহাসবিদ জঁ-পিয়ের ফিলিউ। সেখানে এক মাসের অভিজ্ঞতা শেষে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, ‘ইসরায়েল’ গাজা থেকে সংবাদ প্রচার বন্ধ করতে চাইছে।

হারেৎজ সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল কেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখতে দিতে চায় না, তা আমি এখন বুঝতে পারছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি এর আগে ইউক্রেন, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক ও সোমালিয়ার মতো অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছি, কিন্তু এমন পরিস্থিতি কখনো দেখিনি।’