সাড়ে সাত বছর পর হঠাৎ করেই প্রয়াত স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সবশেষ ২০১৮ সালে কারাগারে যাওয়ার আগে জিয়াউর রহমানের সমাধীতে গিয়েছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলে তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। মানুষের যাতে দুর্ভোগ কম হয় সে কারণেই রাতে আচমকা সিদ্ধান্তে জিয়ার সমাধীস্থলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বুধবার রাত ১১টার দিকে জিয়া উদ্যোনের তার সমাধীস্থলে পৌঁছান। পরে সেখানে গাড়িতে বসেই জিয়াউর রহমানের বিদেহী আত্মার মাগফিত কামনা করে ফাতেহা পাঠ, দোয়া ও মোনাজাত করেন।
সেখানে তিনি বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটান। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের নেতাকর্মী ও পরিবারের সদস্যরাও তার সঙ্গে ছিলেন। এ সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বেগম জিয়া।
তবে এই দোয়া ও মোনাজের একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এর মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হওয়ার বার্তা দিলেন বলেও অনেকে মনে করছেন।
কারণ হিসেবে তাদের ভাষ্য, কয়েকদিন আগেই এক সাক্ষাৎকারে তার ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছিলেন, সুস্থ থাকলে তার মা অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়া ‘রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হতে পারেন’।
আবার দলের নেতাকর্মীরাও সুস্থতা সাপেক্ষ্যে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন ব্যাপকভাবে প্রত্যাশা করছেন। বিশেষ করে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে খালেদা জিয়া সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন—দলটির সকল নেতাকর্মীদের এমন প্রত্যাশাও রয়েছে।
তবে শেষপর্যন্ত এই বয়সে এসে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিতে কতটা সক্রিয় হতে পারবেন কিংবা তারেক রহমান উপস্থিত থাকা অবস্থায় দলের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাকে কতটা যুক্ত করতে পারবেন সেটাও দেখার বিষয়।
আবার এও হতে পারে, খালেদা জিয়ার এ ধরনের কাজ অনেকটা প্রতিকী হিসেবে থাকবে। বিশেষত নির্বাচনের আগে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়াতে অথবা বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজে দেবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
অবশ্য বিএনপির নেতারা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতেই আছেন। তিনি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিলেই দল পরিচালনা করছেন।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেএম জাহিদ হোসেন বুধবার রাতেই বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) রাজনীতি থেকে অবসরে যাননি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (তারেক রহমান) তার পরামর্শ ও নির্দেশনাতেই দায়িত্ব পালন করছেন।’
‘বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো হওয়ায় তিনি নিজেই মাজারে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন’, বলেও যোগ করেন তিনি।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, যেহেতু চেয়ারপারসন সুস্থ হয়ে উঠছেন। সেহেতু এখন রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হতে পারেন। এমনকি তাকে সভা-সমাবেশেও দেখা যেতে পারে।
কারণ খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও দেশ পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে দেশ ও দল লাভবান হবে। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে সভা-সমাবেশে তার উপস্থিতি নেতাকর্মীদের আরও উজ্জীবিত করবে।
তবে দলটির নেতারা এও মনে করেন, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সবকিছুই নির্ভর করছে শারীরিক সুস্থতার ওপর।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেন, ‘সবকিছুই ওনার (খালেদা জিয়া) শারীরিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। সে অনুযায়ী অবশ্যই যথাযথভাবে উপস্থিত থেকে আমাদেরকে নেতৃত্ব দেবেন। এটাই আমরা আশা করি।’
দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) গণতন্ত্রের একজন অগ্রদূত। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন তার নেতৃত্ব।’
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা এস্কান্দর মজুমদার, মা বেগম তৈয়বা মজুমদার। পৈত্রিক নিবাস ফেনীর ফুলগাজী হলেও তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে দিনাজপুরে।
স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮১ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন। প্রথমে ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী (১৯৯১-১৯৯৬, ১৯৯৬-১৯৯৭, ২০০১-২০০৬) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি হন। করোনা মহামারির সময় তৎকালীন সরকার তাকে বিশেষ বিবেচনায় কারামুক্তি দেয়। কারাবন্দি অবস্থায় চারটি ঈদ কেটেছে কারাগারে ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।
পরে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি মুক্তি পান। এরপর দুর্নীতির যে দুটি মামলায় তিনি কারাবন্দি ছিলেন, সেগুলোর রায় বাতিল করেন আদালত। তবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত বেগম জিয়াকে বহুবার হাসপাতালে যেতে হয়।
তিনি সুচিকিৎসার জন্য গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যান। পাঁচ মাস চিকিৎসার পর গত ৬ মে দেশে ফেরেন। সে দিন তিনি গুলশানের বাসা ফিরোজায় প্রবেশ করেন পায়ে হেঁটেই। লন্ডনে ৪ মাস পরিবারের প্রিয় মুখগুলোর সান্নিধ্যে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে আগের চেয়ে সুস্থ বলে জানিয়েছেন তার চিকিৎসক।
পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতিতে নতুন করে উজ্জীবিত দলের নেতাকর্মীরা। তাদের প্রত্যাশা, এবার রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন বিএনপি প্রধান। তিনিও সক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত দিলেন আকস্মিক জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারতের মধ্যে দিয়ে।