আজ পবিত্র জুমাবার। ‘জুমা’ শব্দটি আরবি, যার আভিধানিক অর্থ একত্রিত হওয়া। ইসলাম-পূর্ব যুগে এই দিনকে ‘ইয়াওমুল আরুবা’ বা ‘উরুবা’ বলা হতো। এটি সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিবস এবং ইসলামে সাপ্তাহিক প্রধান ঈদের দিন হিসেবে গণ্য।
জুমা নামকরণ নিয়ে ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কেউ বলেন, এদিন হজরত আদম (আ.)-এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একত্র করে পরিপূর্ণতা দেওয়া হয়েছিল বলে এর নাম ‘জুমা’। আবার কেউ বলেন, এদিন আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর পুনর্মিলন হয়েছিল বলেই এই নাম জুমা।
আরেকটি মত হলো—শহর ও গ্রামাঞ্চলের মুসলমানেরা এদিন একত্র হয়ে জামাতে নামাজ আদায় করে বলেই দিনটির নাম ‘জুমা’।
সপ্তাহের এই নির্দিষ্ট দিনে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানরা একই স্থানে একত্র হয়ে জামাতে জোহরের পরিবর্তে দুই রাকাত ফরজ জুমার নামাজ আদায় করে থাকেন। নামাজের নিয়মে পার্থক্য থাকলেও সময় জোহরের মতোই।
মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় পৌঁছান, দিনটি ছিল শুক্রবার। তিনি বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছে জোহরের সময় হলে সেখানেই প্রথমবারের মতো জুমার নামাজ আদায় করেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জুমার নামাজ।
পরবর্তীকালে মদিনায় আনসার সাহাবিরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মতো মুসলমানদেরও একটি নির্দিষ্ট দিন থাকা উচিত, যেদিন সবাই একত্র হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে। তারা শুক্রবারকে নির্ধারণ করেন এবং এই দিনকে ‘ইয়াওমুল জুমা’ বা জুমার দিন নাম দেন (সিরাতুল মুস্তাফা, দারসে তিরমিজি)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে জুমার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় পরিত্যাগ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম—যদি তোমরা বুঝতে পারো। অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হও।’—সূরা জুমা, আয়াত ৯-১০
হাদিসে জুমার নামাজের ফজিলত বহুবার বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেন,
‘যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে অজু করে জুমার নামাজে আসে এবং মনোযোগ দিয়ে খুতবা শ্রবণ করে, তার এই জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। তবে যে ব্যক্তি খুতবা চলাকালে কাঁকর স্পর্শ করে (অর্থাৎ মনোযোগ হারায়), সে অনর্থক কাজ করল।’—সহিহ মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ
জুমার নামাজ ফরজ এবং তা জামাতে আদায় করা অপরিহার্য। হজরত তারেক ইবনে শিহাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেন, ‘ক্রীতদাস, মহিলা, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া সবার ওপর জুমার নামাজ ফরজ।’—আবু দাউদ ১০৬৭, হাকেম ১০৬২, আস-সুনানুল কুবরা ৫৫৮৭
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামাজ পরিত্যাগ করে, তার নাম মুনাফিকদের তালিকায় এমনভাবে লেখা হয়, যা আর মুছে ফেলা হবে না।’—তাফসিরে মাজহারি, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ২৮৩
জুমার দিনে কিছু ফরজ বিধান রয়েছে। আজানের পর থেকে নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্যবসা, অনর্থক কথাবার্তা কিংবা নামাজ ছাড়া কোনো কার্যক্রম জায়েজ নয়। খুতবা চলাকালে নীরবতা অবলম্বন করা ওয়াজিব এবং কোনো কথাবার্তা বলা হারাম। এমনকি খুতবার সময় সুন্নত বা নফল নামাজ আদায় করাও নিষিদ্ধ। (মেশকাত ৩/৪৩২)।
জুমার দিনের ফজিলতের মধ্যে অন্যতম হলো—এই দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যখন বান্দা যে দোয়া করে, আল্লাহ তা কবুল করেন। হাদিসে এসেছে, ‘জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, যখন কোনো মুমিন বান্দা দোয়া করলে আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন।’—সহিহ মুসলিম ৮৫২, মুসনাদে আহমাদ ৭১৫১
সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো, এই মুহূর্তটি আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত।
এ ছাড়া জুমার দিনে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করার প্রতি বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘যখন কোনো মুসলমান আমার ওপর দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত নাজিল করেন এবং ফেরেশতারা তার জন্য দশবার ইস্তিগফার করে। যে ব্যক্তি জুমার দিন ৮০ বার দরুদ পাঠ করে, তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’—তারগিব ৩/২৯৯
আল্লাহ যেন আমাদের জুমার দিনের আমলগুলো যথাযথভাবে পালন করার তৌফিক দেন। আমিন।
আপনার মতামত লিখুন :