পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদ চত্বরে একটি নৃশংস এবং অমানবিক ঘটনা ঘটেছে। সরকারি এক কর্মকর্তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি ৮টি কুকুরছানাকে বস্তাবন্দি করে পুকুরে ফেলে হত্যা করেছেন। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ফেসবুকে অনেকে এমন নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন।
নিরপরাধ প্রাণী হত্যা শুধু দেশের আইনে দণ্ডনীয় নয়, ইসলামের দৃষ্টিতেও এটি গুরুতর অপরাধ। ইসলামে মানুষসহ সব জীব–জন্তুর অধিকার রয়েছে। প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা ধর্মীয় দায়িত্ব। অন্যায়ভাবে কোনো প্রাণীকে হত্যা করা বা কষ্ট দেওয়া ইসলামে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ।
প্রাণীর প্রতি দয়ার নির্দেশ
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوا أَهْلَ الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ
‘দয়াশীলদের ওপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদেরকে দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ ৪৯৪১)
এটি মানুষসহ সব প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শনে নবিজী (সা.)-এর নির্দেশ। এই হাদিস থেকে স্পষ্টভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে তিনি দুনিয়ার সব জীবের প্রতি দয়া দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কোনোভাইকে মানুষসহ কোনো জীবের অধিকারকে খাটো করে দেখেননি।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَ مَا مِنۡ دَآبَّۃٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا طٰٓئِرٍ یَّطِیۡرُ بِجَنَاحَیۡهِ اِلَّاۤ اُمَمٌ اَمۡثَالُكُمۡ ؕ مَا فَرَّطۡنَا فِی الۡكِتٰبِ مِنۡ شَیۡءٍ ثُمَّ اِلٰی رَبِّهِمۡ یُحۡشَرُوۡنَ
‘ভূ-পৃষ্ঠে চলাচলকারী প্রতিটি জীব এবং বায়ুমন্ডলে ডানার সাহায্যে উড়ন্ত প্রতিটি পাখীই তোমাদের মতো এক একটি জাতি, আমি কিতাবে কোনো বিষয়ই লিপিবদ্ধ করতে বাদ রাখিনি। অতঃপর তাদের সবাইকে তাদের রবের কাছে সমবেত করা হবে।’ (সুরা আনআম: আয়াত ৩৮)
অর্থাৎ, আল্লাহ তাদেরও সৃষ্টিজগতের অংশ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন। কেয়ামতের দিন প্রাণীদেরও পুনরুত্থিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে—হয়রানি হলে তার বিচার হবে, দয়া করলে তার প্রতিদান মিলবে।
হাদিসে প্রাণীর প্রতি দয়া ও শাস্তির উদাহরণ
বুখারি শরিফে একটি বিখ্যাত ঘটনা এসেছে—
غُفِرَ لِامْرَأَةٍ مُومِسَةٍ مَرَّتْ بِكَلْبٍ عَلَى رَأْسِ رَكِيٍّ يَلْهَثُ قَالَ كَادَ يَقْتُلُهُ الْعَطَشُ فَنَزَعَتْ خُفَّهَا فَأَوْثَقَتْهُ بِخِمَارِهَا فَنَزَعَتْ لَهُ مِنْ الْمَاءِ فَغُفِرَ لَهَا بِذَلِكَ
‘‘এক ব্যভিচারিণীকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সে একটি কুকুরের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন সে দেখতে পেল কুকুরটি একটি কূপের পাশে বসে হাঁপাচ্ছে। রাবী বলেন, পানির পিপাসা তাকে মুমূর্ষু করে দিয়েছিল। তখন সেই নারী তার মোজা খুলে তার উড়নার সঙ্গে বাঁধল। অতঃপর সে কূপ হতে পানি তুলল (এবং কুকুরটিকে পানি পান করাল) এ কারণে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হল।’ (বুখারি ৩৩২১)
বিপরীতে আরেক হাদিসে বলা হয়েছে—
عُذِّبَتْ امْرَأَةٌ فِيْ هِرَّةٍ سَجَنَتْهَا حَتَّى مَاتَتْ فَدَخَلَتْ فِيْهَا النَّارَ لَا هِيَ أَطْعَمَتْهَا وَلَا سَقَتْهَا إِذْ حَبَسَتْهَا وَلَا هِيَ تَرَكَتْهَا تَأْكُلُ مِنْ خَشَاشِ الأَرْضِ
‘এক নারীকে একটি বিড়ালের কারণে আজাব দেওয়া হয়েছিল। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল। সে অবস্থায় বিড়ালটি মরে যায়। মহিলাটি ওই কারণে জাহান্নামে গেল। কেননা সে বিড়ালটিকে খানা-পিনা কিছুই করায়নি এবং ছেড়েও দেয়নি যাতে সে জমিনের পোকা-মাকড় খেয়ে বেঁচে থাকত।’ (বুখারি ৩৪৮২)
এই দুই হাদিসে বোঝা যায়, প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া ভয়াবহ গুনাহ, আর তাদের প্রতি দয়া করা মহা সওয়াব।
ইসলামের স্পষ্ট অবস্থান
- প্রাণী হত্যা করা যাবে না, যদি না তা বৈধ কোনো প্রয়োজন হয়।
- বিনা কারণে কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া বা হত্যা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
- প্রাণীর প্রতি দয়া করলে আল্লাহ তার প্রতিদান দেবেন।
- প্রাণীর ওপর নির্যাতন পরকালের শাস্তির কারণ হতে পারে।
ঈশ্বরদীর ঘটনা—ইসলামের দৃষ্টিতে কী?
রোববার (১ ডিসেম্বর) ঈশ্বরদীতে ৮টি কুকুরছানা হত্যা করার যে অভিযোগ উঠেছে, ইসলামের দৃষ্টিতে এটি স্পষ্টভাবে অপরাধ, নির্মমতা, এবং মানবিকতার পরিপন্থী। ধর্মীয় শিক্ষায় এ আচরণের কোনো সমর্থন নেই।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রাণীসহ আল্লাহর সৃষ্টি—সব জীবের প্রতি দয়া ও সদয় হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।

