বিনামূল্যের পাঠ্যবই উৎপাদন ও বিতরণের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নিয়োগ করা ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ না থাকা, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) লঙ্ঘন করে সর্বনিম্ন পাঁচ দরদাতাকে বাদ দিয়ে ছয় নাম্বার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া এবং ভারতীয় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকার পরও ‘ব্যুরো ভেরিতাস’কে বইয়ের গুণগত মান যাচাইয়ের কাজ দেওয়ায় এ বিতর্কের সৃষ্টি। তবে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্পন্ন বই তুলে দেওয়ার জন্য সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
জানা গেছে, আগামী ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মোট ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৪০ হাজার ৩৯১ শিক্ষার্থীর জন্য মোট ৪০ কোটি ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮ কপি বই ছাপানোর কাজ করছে এনসিটিবি। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের ২ কোটি ১৪ লাখ ২১ হাজার ২১১ জন্য শিক্ষার্থীর জন্য ছাপা হচ্ছে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৬০৬ কপি বই। অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের ২ কোটি ৩৪ লাখ ১৯ হাজার ১৮০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপার প্রস্তুতি চলছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই।
উৎপাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত এসব বইয়ের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য নিজস্ব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তদারকরি কাজ করার পাশাপাশি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ‘ইন্সপেকশন এজেন্ট’ নিয়োগ দেয় এনসিটিবি। সাধারণত দুই পর্বে এই ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। বই উৎপাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত সব কাজ তদারকের জন্য প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) ও মাঠপর্যায়ে বই পৌঁছার পর পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন (পিএলআই) বইয়ের গুণগত মান যাচাই করে প্রতিবেদন পাঠায় এনসিটিবিতে।
প্রাথমিক স্তরে বইয়ের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য পিডিআই ও পিএলআই একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হলেও মাধ্যমিক স্তরে দুই পর্বের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠানকে তদারকের দায়িত্ব দেওয়ার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। ওপেন টেন্ডার পদ্ধতিতে (ওটিএম) এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা কাজ পাওয়ার জন্য মনোনীত হন।
আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য বই প্রস্তুতির বিষয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার কাজ ভালোভাবে চলছে। তবে মাধ্যমিক স্তরের কোনো শ্রেণির বই এখনো ছাপাই শুরু হয়নি। মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার জন্য বেশ কয়েকটি প্রেস এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তি করলেও ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ না হওয়ায় কাজ তেমন আগায়নি। এদিকে নতুন বছর আসতে বাকি রয়েছে আর মাত্র ২০ দিন।
চলতি বছর মাধ্যমিক স্তরের পিডিআই ও পিএলআই এজেন্ট নিয়োগের জন্য গত ৭ নভেম্বর দরপত্র খোলা হয়। পিডিআইয়ের দরপত্রে মোট ৬টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এ কাজের জন্য এনসিটিবির প্রাক্কলিত দর ছিল ৭৫ লাখ টাকা। প্রাক্কলিত দরের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসের দর ছিল ৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডির ৯ লাখ টাকা, ইন্ডিপেনডেন্ট ইন্সপেকশন সার্ভিস বিডির ১৫ লাখ টাকা, শেখ ট্রেডিং অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসের ১৯ লাখ এবং ইনফিনিটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দর ছিল ২০ লাখ ৬০ হাজার ৪২২ টাকা। দরপত্রে অংশ নিয়ে ষষ্ঠ স্থানে থাকা ব্যুরো ভেরিতাসের দর ছিল সর্Ÿোচ্চ ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৩৫৫ টাকা।
অন্যদিকে পিএলআইয়ের দরপত্রেও অংশ নেয় এই ৬টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতার কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডির দর ছিল ৭১ হাজার টাকা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা হাইটেকের দর ছিল ১ লাখ ৩ হাজার টাকা। তৃতীয় স্থানে শেখ ট্রেডিংয়ের দর ছিল ৫ লাখ টাকা। এরপর যথাক্রমে ইন্ডিপেনন্ডেন্ট বিডির দর ৭ লাখ টাকা, ইনফিনিটির ৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ও ষষ্ঠ স্থানে থাকা ব্যুরো ভেরিতাসের দর ছিল সর্বোচ্চ ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এরই মধ্যে পিডিআইয়ের দরপত্র মূল্যায়ন করে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান ব্যুরো ভেরিতাসকে কাজের ছাড়পত্র দিয়েছে এনসিটিবি। বই উপজেলা যাওয়ার পর যেহেতু পিএলআইয়ের কাজ শুরু হয়, তাই এই পর্বের দরপত্রের মূল্যায়ন এখনো হয়নি।
পিডিআইয়ে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর দর থেকে দেখা গেছে, এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরের চেয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হাইটেকের দর ছিল ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ মাইনাসে। পরবর্তী চারটি প্রতিষ্ঠানেরও দরও প্রায় কাছাকাছি।
আর ষষ্ঠ স্থানে থেকে কাজ পাওয়া ব্যুরো ভেরিতাসের দর ছিল ৫৬ শতাংশ মাইনাসে। গত বছরও প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ মাইনাসে মাধ্যমিক স্তরের পিডিআইয়ের কাজ পেয়েছিল ইনফিনিটি।
এদিকে পিডিআইয়ের দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রথম পাঁচ প্রতিষ্ঠান ‘ডিসকোয়ালিফাই’ না হওয়ার পরও ষষ্ঠ স্থানে থাকা সর্বোচ্চ দরের ব্যুরো ভেরিতাসকে কাজ দেওয়া নিয়ে সমালোচনা চলছে অংশীজনদের মধ্যে। পিপিআরের বিধান অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতার কাজ পাওয়ার অধিকার থাকলেও তা নিশ্চিত হয়নি। এ ছাড়া গতবছর প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক কম দর পড়ায় তৃতীয়বার টেন্ডারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। এবারও প্রায় ৯০ শতাংশের নিচে দর পড়ায় রিটেন্ডারের সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি। এ ছাড়া ব্যুরো ভেরিতাসকেও কাজ দেওয়া হয়েছে ৫৬ শতাংশ কম দরে।
দ্বিতীয়ত, বইয়ের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য গ্লজ টেস্টার, স্টিফনেস টেস্টার, বার্স্টিং স্ট্রেংথ টেস্টার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ মেশিন না থাকলেও কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তৃতীয়ত, ব্যুরো ভেরিতাস ফ্রান্সের কোম্পানি হলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ভারতীয় অমিত ঘোষ। প্রয়োজনীয় সব শর্ত নিশ্চিত করে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দেওয়া কি একেবারেই সম্ভব ছিল না, প্রশ্ন ওঠেছে তা নিয়েও।
পিডিআই দরপত্রে অংশ নিয়ে চতুর্থ স্থানে থাকা শেখ ট্রেডিং অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসেসের প্রধান নির্বাহী রাফি মাহমুদ বিপ্লব রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের মর্মাহত করেছে। নিয়ম অনুযায়ী এনসিটিবি আমাদের সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। কোন মানদণ্ডেই আমাদের ‘ডিসকোয়ালিফাই’ করা হয়নি।’
প্রাক্কলিত দরের চেয়ে এত কম রেট দিয়ে কি ভালো কাজ করা সম্ভব এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে এনসিটিবি রিটেন্ডার করতে পারত। গত বছরও এমন হয়েছে। বিষয়টি আমাদের জন্য কষ্টের।
অন্যদিকে একটি সক্ষম প্রতিষ্ঠানের মেশিনারিজ থাকার বিষয়ে এনসিটিবির ঞবহফবৎ ঝপযবফঁষব এর ১৪নং পৃষ্ঠায় ITT Clause 14.1 G ¯úó ejv Av‡Q The Tenderer Shall have Own Testing Laboratory and Own Testing machineries (Balance, Gloss Tester, Stiffness Tester, Brightness Tester, Bursting Strength Tester, Opacity Tester, Microscope, Thickness Tester, Oven, Stop Watch, Siæing Tester) to perform all necessary tests of paper and cover as mentioned in Annexure A and B।
এ বিষয়ে পিডিআইয়ের কাজ পাওয়া ব্যুরো ভেরিতাস পরিদর্শনে যাওয়া সদস্য সূত্রে জানা গেছে, বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় দুটি মেশিন পরিদর্শনের পাওয়া যায়নি। ব্যুরো ভেরিতাসের পক্ষে জানানো হয়েছে, কাজ পেলে শিগগিরই মেশিন দুটি তারা নিয়ে আসবে। যত দিন মেশিন না আসে তত দিন ওই দুটি কাজ তারা বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ও টেস্টিং ইনস্টিউিশন (বিএসটিআই) থেকে করিয়ে দেবে।
অন্যদিকে ব্যুরো ভেরিতাসের ভারতীয় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সম্পর্কে ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এটি ফ্রান্সের একটি কোম্পানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। পুরো বিশ্বকে কয়েকটি ক্লাস্টারে ভাগ করে এরা কার্যক্রম পরিচালনা করে যেমন-সাউথ ইস্ট এশিয়া জোনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কাজ করে ব্যুরো ভেরিতাস। সাউথ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি অফিস রয়েছে ভারতে। এ ছাড়া বাংলাদেশের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কায় কাজ করে ব্যুরো ভেরিতাস। ব্যুরো ভেরিতাসের সিনিয়র সহসভাপতি ভারতীয় অমিত ঘোষ সাউথ ইস্ট এশিযা জোনের কার্যক্রম তদারক করেন।
ব্যুরো ভেরিতাসের সঙ্গে বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সোহেল আজাদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ব্যুরো ভেরিতাসের বাংলাদেশের কার্যক্রম পরিচালিত হয় সিঙ্গাপুর থেকে। ভারতীয় অমিত ঘোষ ব্যুরো ভেরিতাসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।
ব্যুরো ভেরিতাসের কাজ পাওয়া নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ৯০ শতাংশের নিচে দর দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে বইয়ের মান যাচাই আদৌ সম্ভব। প্রতিবছরই প্রতিষ্ঠানগুলো এমন দর দিয়ে কাজ নেয়, তারপর প্রেসগুলো থেকে সুবিধা আদায় করে।
দ্বিতীয়ত, একাধিক মেশিনারিজ না থাকার অভিযোগ ঠিক নয়। তাদের এখন একটি মেশিন নেই। শিগগিরই তারা সেটি নিয়ে আসবে। যত দিন না আনবে তত দিন বিসিএসআইআর ও বিএসটিআই থেকে কাজ করিয়ে নেবে।
তৃতীয়ত, ব্যুরো ভেরিতাস ভারতীয় কোনো কোম্পানি নয়। এটা ফরাসি একটি কোম্পানি। তবে ভারতীয়রা শীর্ষ পদে কাজ করতে পারেন। এমনতো ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংকেও করেন। তাতে কি তাদের বাদ দেওয়া যাবে।
অন্যান্য বছর যা হয়েছে, তা আর এ বছর হবে না এমন প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, মানসম্পন্ন বই পাওয়ার জন্য সর্বোত্তম সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :