বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪, ১২:৪৭ এএম

জাদুঘরে নেই ’২৪ বিজয়ের চিহ্ন

উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪, ১২:৪৭ এএম

জাদুঘরে নেই ’২৪ বিজয়ের চিহ্ন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সাবেক আওয়ামী সরকারের পতনের পর আজ সোমবার দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে ৫৩তম মহান বিজয় দিবস। স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে আজকের এই দিনে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শাসন-শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়েছিল বাঙালি জাতি। অন্যদিকে ১৫ বছর পর আওয়ামী শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি এবারের বিজয়ের আনন্দোৎসবকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। 

সারা দেশের মানুষের মধ্যে মহান বিজয় দিবস পালনের পাশাপাশি আওয়ামী সরকারের পতন ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবে অভিহিত হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তকেও স্থান পাচ্ছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অনেক বীরত্বগাথা। অথচ জাতির মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে দ্বিতীয় স্বাধীনতার চেতনা সম্পর্কিত কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি গত ছয় মাসেও। নেই ’২৪ বিজয়ের কোনো নিদর্শন। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় জাদুঘরের শাখা স্বাধীনতা জাদুঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও সংস্কারের উদ্যোগ ঝুলে আছে প্রায় একই সময় ধরে। বাকি ৯টি শাখা জাদুঘরের কর্মকাণ্ডও চলছে ঢিমেতালে।

এ বিষয়ে জানা গেছে, সাবেক সরকারের পতনের পর জাদুঘর পরিচালনা পর্ষদ অকার্যকর হয়ে পড়ায় সার্বিকভাবেই স্থবির হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় জাদুঘর। জাদুঘর আইন দ্বারা একটি পর্ষদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। সরকার মনোনীত ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক পদাধিকারবলে পর্ষদের সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। জাদুঘরের ওয়েবসাইটে গত ২৩ অক্টোবর হালনাগাদ করা ২০২২-২৩ পর্ষদ দেখে জানা গেছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা, সাবেক আমলা, শিক্ষাবিদ ও সমাজের বিশিষ্ট ১৬ জনসহ মোট ১৮ জন নিয়ে পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। আর পর্ষদের সদস্যসচিব পদে রয়েছেন জাদুঘরের বর্তমান মহাপরিচালক গ্রেড-১ পদের কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান। অতিরিক্ত সচিব পদের এই কর্মকর্তা বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।

জাদুঘর সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্ট সাবেক সরকারের পতনের পর পর্ষদ চেয়ারম্যানসহ অন্য সদস্যরা জাদুঘরে আসেননি। নতুন পর্ষদও গঠিত হয়নি। পর্ষদের অকার্যকারিতায় জাদুঘরের কাজেও তাই কোনো অগ্রগতি নেই। জাদুঘরের বিভিন্ন গ্যালারি ও সোহারওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত স্বাধীনতা জাদুঘর ঘুরে দেখা গেছে, জাদুঘরের ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলার ‘বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামের ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর গ্যালারিতে আগের মতোই ভাষা আন্দোলনের অলোকচিত্র, ভাষাশহিদ শফিউর রহমানের রক্তে ভেজা শার্ট-কোট, শেরেবাংলার টুপি, আলতাফ মাহমুদের হারমোনিয়ামসহ স্বাধীনতাসংশ্লিষ্ট সব নিদর্শন রয়েছে। মূলত এই বিভাগই সাজানো হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা নিদর্শন নিয়ে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, পরবর্তী সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে গ্যালারি বা নিদর্শনের কিছুই এখানে দেখা যায়নি।

অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘর ঘুরে দেখা গেছে, শুধু ইট-পাথরের স্থাপনা ছাড়া জাদুঘরের ভেতরে রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ। এই জাদুঘরের পাঁচটি গ্যালারিই বর্তমানে আগুনে পুড়ে ছাই ও ভাঙা কাচের গোডাউনে পরিণত হয়েছে। ২৫ মার্চের কালরাতের দুঃসহ স্মৃতি মনে করাতে তৈরি ‘ব্ল্যাক জোন’ গ্যালারি যেন সত্যিকার অর্থেই নির্যাতন ও ধ্বংসের বাস্তব প্রতীক হয়ে উঠেছে। এসব গ্যালারিতে অনেক জিনিসের সঙ্গে স্বাধীনতার নিদর্শন হিসেবে থাকা পাঁচ-ছয়টি অস্ত্রও লুট হয়ে গেছে।

এসব বিষয়ে জাদুঘরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মূলত পর্ষদ না থাকায় জাদুঘরের কর্মকাণ্ডে কোনো গতি নেই। একই কারণে জাদুঘরের ১০ শাখা জাদুঘরেরও একই অবস্থা। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর।

সূত্রগুলো জানায়, জাদুঘরের সচিব (অতিরিক্ত সচিব) গাজী মো. ওয়ালি-উল-হক বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছেন। উনি দেশে ফেরার পর জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বৈষম্যবিরোধি ছাত্র আন্দোলন ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কারো কাছে কোনো নিদর্শন থাকলে তা জাদুঘরে জমা দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। পরে এসব নিদর্শন দিয়ে গ্যালারি প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতা জাদুঘরের ক্ষতি নিরূপণ করে গত আগস্ট মাসের শেষে জাদুঘর থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এখনো কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। লুট হওয়া অস্ত্র ও নিদর্শনসামগ্রীর বিষয়ে শাহবাগ থানায় ওই সময় জিডি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদলও সরেজমিনে এসব দেখে-শুনে গেছেন।

এসব বিষয়ে জানতে ফোনে জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. আতাউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

মহাপরিচালক তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) ইন্তাজ আলীর মাধ্যমে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সংগ্রাম ও ইতিহাস নিয়ে গ্যালারি প্রতিস্থাপনের আলাপ চলছে। আর স্বাধীনতা জাদুঘর সংস্কারের বিষয়টি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সম্মতির অপেক্ষায় রয়েছে।

জানা গেছে, ৯৩ হাজার ২৪৬টি নিবন্ধিত নিদর্শনসমৃদ্ধ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জাদুঘর। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে চারতলা ভবনের ৪৫টি গ্যালারিতে প্রায় ৪ হাজার ১৭৮টি নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, তিনটি মিলনায়তন ও দুটি প্রদর্শনী গ্যালারি। চারটি কিউটোরিয়াল বিভাগ তথা ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগ, জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ বিভাগ, সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগ এবং প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগের ব্যবস্থাপনায় এসব নিদর্শন প্রদর্শিত হয়। প্রতিটি বিভাগ পরিচালনার জন্য রয়েছেন ‘কিপার’ পদের একজন কর্মকর্তা। এই চার বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বড় ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগেই রয়েছে ৭৩ হাজার নিদর্শন।

জাদুঘরের বৃহত্তম ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা কিউরেটরিয়াল বিভাগে ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামের ওপর ‘বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক বিষয়ভিত্তিক স্থায়ী প্রদর্শনী দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে, যা এই বিভাগের নবতর সংযোজন। এই বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শনীতে ইতিহাসের একটি দীর্ঘ সময়কে (২৩ জুন, ১৭৫৭, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১) ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের (১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত) একটি স্থায়ী প্রদর্শনী গ্যালারিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে কোথাও নেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের কোনো নিদর্শন। 

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আওতাধীন ১০টি শাখা জাদুঘর রয়েছে।

যেমন: আহসান মঞ্জিল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, ওসমানী জাদুঘর, জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর, স্বাধীনতা জাদুঘর, পল্লী কবি জসীমউদ্দীন জাদুঘর ও লোক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদারবাড়ি জাদুঘর, শহিদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।

১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন সচিবালয়ের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষে ৩৭৯টি নিদর্শন নিয়ে ‘ঢাকা জাদুঘর’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট জাদুঘরটি দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকা জাদুঘর ঢাকার নায়েব-নাজিমের নিমতলীর প্রাসাদের বারদুয়ারী ও দেউরীতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭০ সালে তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার ঢাকা জাদুঘর প্রযত্ন বোর্ড অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় পরিণত করে। ১৯৭২ সালে সরকারের কাছে জাতীয় জাদুঘর প্রকল্প পেশ করে। ১৯৭৪ সালে জাতীয় জাদুঘর কমিশনের সুপারিশে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে অনুমোদিত হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ জারি করে ঢাকা জাদুঘরের সব সম্পদ, নিদর্শন, দায়-দায়িত্বসহ সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সঙ্গে আত্তীকৃত করা হয়। ১৭ নভেম্বর ১৯৮৩ সালে বর্তমান ভবনে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য তথা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উপাদান, প্রত্ননিদর্শন এবং মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রহ জাদুঘরের মূল আকর্ষণ। ঐতিহাসিক নিদর্শনাদি যেমন প্রস্তর ও ধাতব ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলক, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় মুদ্রা, শিলালিপি, তুলট কাগজ ও তালপাতায় লেখা সংস্কৃত, বাংলা ও আরবি-ফার্সি পাণ্ডুলিপি, মধ্যযুগীয় অস্ত্রশস্ত্র, বাংলাদেশের দারু ও কারুশিল্প, নকশিকাঁথা, সমকালীন ও বিশ্বসভ্যতার চিত্রকলা ও ভাস্কর্য, বাংলাদেশের গাছপালা, পশুপাখি, শিলা ও খনিজ ইত্যাদি প্রাকৃতিক নিদর্শন জাদুঘরের মূল সংগ্রহ। প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি দর্শক জাদুঘর পরিদর্শনে আসেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!