২০২৫ শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে সপ্তাহখানেক। এই সময়ের মধ্যে দশম শ্রেণির বাংলা ভার্সনসহ পাঁচ ধারার প্রায় ৩৮ লাখ শিক্ষার্থী গতকাল রোববার পর্যন্ত কোথাও তিনটি (বাংলা, ইংরেজি ও গণিত), আবার কোথাও দুটি বই পেয়েছে। অথচ দশম শ্রেণির এই শিক্ষার্থীদের এই শিক্ষাবর্ষেই সিলেবাস শেষ করে ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।
এদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বিনা মূল্যের পাঠ্যবই বিতরণের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর বই পেতে ফেব্রæয়ারি মাস পার হয়ে যাবে। কিন্তু শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনি পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। অর্থাৎ একদিকে বছরের শুরুতে সব বই না পাওয়ায় শিক্ষাবর্ষের পূর্ণ ব্যবহার না করতে পারার শঙ্কা নিয়েই ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে শিক্ষার্র্থীদের। বিষয়টি নিয়ে চরম বিপাকে শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষার্থীদের বই সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
এনসিটিবির দশম শ্রেণির বই বিতরণের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বাংলা ভার্সনসহ পাঁচ ধারার প্রায় ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজন ৫ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার ১২ কপি বই। এর মধ্যে বাংলা ভার্সনের ২৭ লাখ ২১ হাজার ৪২১ শিক্ষার্থীর জন্য ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৯৪ হাজার ৯৭৬ কপি, ইংরেজি বার্সনের ২৬ হাজার ৯৪১ শিক্ষার্থীর জন্য ৪ লাখ ৩২ হাজার ৪৮২ কপি, মাদরাসা শিক্ষাধারায় ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৩৫৬ শিক্ষার্থীর জন্য ৫৯ লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৫ কপি, কারিগরি শিক্ষাধারায় ৩ লাখ ২১ হাজার ৯৮৬ শিক্ষার্থীর জন্য ৩৭ লাখ ৯২ হাজার ৮৪০ কপি ও মাদরাসা শিক্ষাধারা (কারিগরি) ২০ হাজার ৭৫২ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ কপি বই ছাপার কাজ করছে এনসিটিবির কাজ পাওয়া প্রেসগুলো।
২০২২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী এই শ্রেণিতে বিষয় ছিল ১৪টি। ২০১২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী চলতি শিক্ষাবর্ষে এই শ্রেণির বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষায় রয়েছে মোট ৩৩টি বিষয়। অর্থাৎ বিষয় বেড়েছে প্রায় ১৯টি। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে এই শ্রেণির প্রতি শিক্ষার্থী পাবে ১৫টি বই।
বই বিতরণে এনসিটিবির পরিকল্পনা অনুযায়ী গতকাল রোববারের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির সব বই, ১০ জানুয়ারির মধ্যে মাধ্যমিকের প্রায় আটটি বই এবং ২০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীরা পেয়ে যাওয়ার কথা। অথচ গতকাল পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের ১০ কোটির কিছু বেশি বই বিতরণের খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বইয়ের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) হিসাব অনুযায়ী গতকাল পর্যন্ত মোট ৫৬ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮ কপি বই বিতরণের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত সপ্তাহখানেক সময়ে উপজেলা পর্যায়ে কত বই বিতরণ করা হয়েছে তার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
এদিকে পিডিআইয়ের করা বইয়ের হিসাব আর উপজেলা পর্যায়ে বিতরণের হিসাবে বরাবরই গরমিলের অভিযোগ পাওয়া যায়। তাই পিডিআইয়ের হিসাব সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাধারণত বই ছাপা হওয়ার পর গুনে সংখ্যা নির্দিষ্ট করে পিডিআইয়ের হিসাব দেওয়া হয়। তবে সেসব বই হয়তো ট্রাকে করে উপজেলা পর্যায়ে পাঠাতে দু-এক দিন সময় লাগে।
সূত্রের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতেও বিষয়টি পরিষ্কার যে, গতকাল পর্যন্ত পিডিআইয়ের করা ৫৬ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮ কপি বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাতে দুই দিন সময় লাগবে। কিন্তু বইয়ের সংখ্যা যোগ করা হয়েছে গতকালের হিসাবে।
এ বিষয়ে সূত্র বলেন, উপজেলা পর্যায়ে কত বই পৌঁছেছে, তা জানার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। তাই গতকাল পর্যন্ত ৩৮ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত তিনটি বই পেয়েছে তা নিশ্চিত নয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের গত ১ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘২০২৫ সালে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা (২০২৬ সালের অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষা) নেওয়ার লক্ষ্যে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা অব্যাহত রেখে পূর্বের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২-এর আলোকে প্রণীত সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তকসমূহ (অর্থাৎ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ব্যবহৃত পুস্তক) শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করা হবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ অনুসারে প্রণীত শাখা বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাভিত্তিক এই পাঠ্যপুস্তকসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা এক শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই পাঠ্যসূচিটি সম্পন্ন করতে পারে। পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ অনুসারে পরিচালিত হবে।’
পরিপত্র অনুসারে, ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে সংশোধিত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন পাঠ্যক্রম অনুসারে এক বছরের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস রুটিন শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। ইতিমধ্যে এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রশ্নের ধরন, সময় ও নম্বর বণ্টন করেছে এনসিটিবি। সিলেবাসে থাকা বিষয়গুলো রচনামূলক অংশের ৭০ নম্বর এবং বহু নির্বাচনি অংশ ৩০ নম্বর থাকবে। ব্যবহারিক বিষয়গুলোতে তত্ত¡ীয় অংশে ৭৫ ও ব্যবহারিক অংশে ২৫ নম্বর থাকবে। তত্ত্বীয় অংশে ৪০ নম্বর ও বহু নির্বাচনি অংশে ২৫ নম্বর থাকবে। তবে শিক্ষাপঞ্জিতে বছরের প্রথম দিন থেকে প্রতিটি বিষয়ে গড়ে ৭৫ থেকে ৯২টি ক্লাস হওয়ার কথা। তবে এই ক্লাসগুলোতে পূর্ণাঙ্গ শ্রেণি কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয় না। কারণ ক্লাস টেস্টসহ অনেক কাজ থাকে। তাই বই না পাওয়ায় শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকেই বিপাকে পড়েছে দশম শ্রেণির প্রায় ৩৮ লাখ শিক্ষার্থী।
শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বই না পেলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিখন সংকট তৈরি হতে পারে বলে গত বছর নভেম্বর মাসে আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ। বই পাওয়া নিশ্চিত না হলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এই শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন সংকট তৈরি হতে পারে বলে প্রতিবেদনে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন শিক্ষক, গবেষক ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য করা সংক্ষিপ্ত সিলেবাস নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শিক্ষকরা। তবে তাদের উদ্বেগ রয়েছে বই পাওয়া নিয়ে। এ বিষয়ে ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুব হাসান লিংকন বলেন, চলতি বছর ১১টি জাতীয় দিবসের ছুটি, রোজা ও কোরবানির ঈদ, দুর্গাপূজা ও সাপ্তাহিক দুই দিন ছুটি ধরে একটি দীর্ঘ সময় ক্লাস বন্ধ থাকবে। ফলে শিক্ষাবর্ষের অনেকটা সময় এই ছুটিতে শেষ হবে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা যদি বছরের প্রথম দিন থেকে বইয়ের পুরো সেট পেত, তাহলে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে শুরু হয়ে শেষ হতে পারত। কিন্তু তা না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সমস্যা হবে। এ সমস্যা সমাধানে চলতি বছরের মার্চে রোজার সময় অতিরিক্ত শ্রেণি কার্যক্রম চালানো সম্ভব কি না তা বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই শিক্ষক।
রাজধানীর পুরান ঢাকার একাধিক সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা দশম শ্রেণির সিলেবাস নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন।
অন্যদিকে বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, গতকালও একটি বই পায়নি তার সন্তান।
রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, গত বৃহস্পতিবার তার সন্তান চারটি বই পেয়েছে। এরপর আর একটিও পায়নি। এই অভিভাবকের আরেক সন্তান পড়ে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের প্রি-প্রাইমারিতে। গতকাল পর্যন্ত সে একটি বইও পায়নি।
বই না পাওয়ায় সমস্যা হবে স্বীকার করলেও কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেন এনসটিবির সদস্য (কারিকুলাম) প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী। তিনি বলেন, আমি নিজে খুলনা জেলা স্কুলসহ দু-তিনটি স্কুলের প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছেন, বই আসতে দেরি হবে বুঝতে পেরে তারা ইতিমধ্যে অনলাইনে আপ করা পিডিএফ ভার্সনের বইয়ের থেকে সিলেবাসে সংযুক্ত অংশটুকু বা কয়েক পাতা প্রিন্ট নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আবার কেউ জানিয়েছেন, বই আসতে দেরি হতে পারে ধরে নিয়ে তারা ইতিমধ্যে স্কুলের বার্ষিক মিলাদ মাহফিল, বিদায় সংবর্ধনা জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো শেষ করে ফেলছেন। ইতিমধ্যে বই চলে গেলে আর সমস্যা হবে না।
প্রেসগুলো যদি আন্তরিক না হয়ে দুই-তিন দিনের মধ্যে বই না দেয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের অপরিমেয় ক্ষতি হবে বলে স্বীকার করেছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিশেষ করে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী, যারা ২০২৬ সালে এসএসসি দেবে, তারা যেন দ্রæত বই পায়। এ জন্য আমি সব প্রেসকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দশম শ্রেণির বই ছাপার নির্দেশনা দিয়েছি। তারা যদি আগামী তিন দিনের মধ্যে বই সরবরাহ না করতে পারে, তবে পরবর্তী সময়ে তাদেরও বিড়ম্বনায় পড়তে হবে।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের জন্য ৪০ কোটির বেশি বিনা মূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ করছে এনসিটিবি। মোট বইয়ের মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটির বেশি ও মাধ্যমিক স্তরে রয়েছে ৩১ কোটি বই।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন