বিশ্ব ফুটবল জগতে নতুন এক ধরনের টেকটনিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, যা আগামী দিনে বিশ্ব ফুটবল শাসন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। নেদারল্যান্ডস থেকে প্রকাশিত একটি ক্লাস অ্যাকশন মামলা ফিফার বিরুদ্ধে নতুন সুনামি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই মামলা, যা ‘জাস্টিস ফর প্লেয়ার্স’ (জেএফপি) নামক একটি প্লেয়ার গ্রুপের উদ্যোগে শুরু হয়েছে।
মামলায় দাবি করা হয়েছে, ২০০২ সাল থেকে সক্রিয় পেশাদার ফুটবলারদের ক্যারিয়ারকে ফিফার নিয়মাবলি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং এর জন্য ফিফাকে খেলোয়াড়দের আয় থেকে প্রায় ৮% ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
মামলার বিস্তার ও অর্থনৈতিক প্রভাব
এই মামলাটিতে অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মামলা যদি সফল হয়, তবে ফিফাকে বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বোচ্চ আদালত (সিজেইইউ) -এর গত বছরের লাসানা দিয়ারা মামলার রায়কে ভিত্তি করে এটি তৈরি হয়েছে।
সেই রায়ে বলা হয়েছিল, ফিফার নিয়মাবলি খেলোয়াড়দের চলাফেরার স্বাধীনতা হ্রাস করে এবং কিছু নিয়ম ‘অপ্রতিযোগিতামূলক’। জেএফপি গ্রুপের উদ্দেশ্য শুধু আর্থিক ক্ষতিপূরণ নয়, তারা চায় ফিফার ট্রান্সফার নীতিমালায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হোক।
সম্ভাব্য পরিবর্তন ও প্রস্তাবিত সমাধান
মামলার অংশ হিসেবে বিভিন্ন পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো স্পেনের মতো দেশের প্রতিটি খেলোয়াড়ের চুক্তিতে ‘রিলিজ ফি’ বা মুক্তিপণ ধার্য করার কথা।
তা ছাড়া খেলোয়াড়দের চুক্তির মেয়াদ ছোট করা হতে পারে, যেমন ৪ বছরের বদলে ২ বছর বা ২+১ বছরের চুক্তি, যা ট্রান্সফার ফি কমাতে সাহায্য করবে। তবে এতে খেলোয়াড়দের বেতন বাড়ানোর চাপ পড়ার সম্ভাবনাও আছে।
মামলায় আইনি নেতৃত্ব ও পেছনে রয়েছেন যারা
এই মামলা পরিচালনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বেলজিয়ামের ডুপন্ট-হিসেল আইন ফার্ম। এই ফার্মের জ্যঁ-লুই ডুপন্ট ১৯৯৫ সালের বিখ্যাত ‘বোসম্যান’ মামলার আইনজীবী ছিলেন।
যা ইউরোপীয় ফুটবলে ট্রান্সফার সিস্টেমের আধুনিক রূপ গড়ে তোলার পেছনে অন্যতম প্রভাবশালী মামলা। পাশাপাশি, জেএফপি বোর্ডে রয়েছেন টটেনহামের প্রাক্তন টেকনিক্যাল ডিরেক্টর এবং ইংল্যান্ড দলের সহকারী ম্যানেজার ফ্রাঙ্কো বালদিনিও। যিনি ফুটবল জগতের সুনামের পরিচিত মুখ এবং পরিবর্তনের প্রবক্তা।
অন্যান্য আইনি দ্বন্দ্ব ও ফিফার সঙ্গে সংঘাত
ফিফার বিরুদ্ধে শুধু এই মামলা নয়, আরও একাধিক আইনি চ্যালেঞ্জ চলছে। গত বছর ইউরোপীয় লিগ এবং গ্লোবাল প্লেয়ার্স ইউনিয়ন ফিফার আন্তর্জাতিক ম্যাচ ক্যালেন্ডার পরিবর্তনে যথাযথ পরামর্শহীনতার অভিযোগ এনেছিল ইউরোপীয় কমিশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে।
এ ছাড়া ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো এবং খেলোয়াড়দের প্রতিনিধিত্বকারী ইউনিয়ন ‘ফিফপ্রো’র মধ্যে বিবাদ তীব্র হয়েছে। ফিফা ফিফপ্রোকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করার অভিযোগ এনে তাদের আর্থিক তথ্য প্রকাশের দাবি করেছে, যা খেলোয়াড়দের একক ঐক্যের জন্য বাধা সৃষ্টি করছে।
ভবিষ্যৎ পথ ও ফুটবল শাসনের পুনর্গঠন
এই আইনি লড়াইয়ের পেছনে শুধু ফুটবল খেলোয়াড়দের অধিকার সুরক্ষার চেষ্টাই নয়, বরং ইউরোপীয় ক্রীড়া শাসনের কাঠামো পুনর্গঠনের দাবি রয়েছে। ফিফার মতো প্রতিষ্ঠান কি শুধু নিয়ন্ত্রক হিসেবে থাকবেন। নাকি প্রতিযোগিতার আয়োজক হিসেবেও থাকবে? ২০১৯ সালের ইউরোপীয় সুপার লিগ মামলা থেকে উঠে আসা এই প্রশ্নগুলো এখন নতুন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
সমাধানের সম্ভাবনা
বিভিন্ন সূত্র বলছে, অনেকাংশে এই মামলা হয়তো আদালতে না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে মিটমাট হবে। তবে যেকোনো সমাধানে ফিফার ট্রান্সফার নীতিমালা এবং খেলোয়াড়দের অধিকার পুনর্বিবেচনা অপরিহার্য হবে।
জেএফপির আশা, এই মামলাটি ফিফাকে তার কঠিন শাসনব্যবস্থা পুনর্বিবেচনার জন্য বাধ্য করবে এবং ফুটবল জগতকে আরও ন্যায়সঙ্গত ও সুশাসিত করবে।
এদিকে এই মামলার বিষয়ে বিশ্ব ফুটবল সংস্থা (ফিফা) এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান