ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক জটিল কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করছেন। একদিকে রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের কৌশলগত বন্ধুত্ব বজায় রাখছেন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব যখন বিভক্ত, তখন ভারত ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের এ অবস্থানকে আর সহজভাবে নিচ্ছেন না।
সম্প্রতি ট্রাম্প ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর বাণিজ্যিক পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ভারতের রাশিয়া থেকে তেল কেনার সমালোচনা করে এটিকে ‘রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রকে সহযোগিতা’ বলে অভিহিত করেছেন।
এর জবাবে, তিনি ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন, যা চলতি সপ্তাহেই কার্যকর হয়েছে। একই সঙ্গে, রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির কারণে অতিরিক্ত আরও ২৫% শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন, যা মাসের শেষে কার্যকর হতে পারে।
এই নতুন শুল্কগুলো মিলিয়ে ভারতের পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক দাঁড়াবে ৫০%- যা যুক্তরাষ্ট্রে আরোপিত অন্যতম সর্বোচ্চ শুল্ক।
কেন ভারত রাশিয়ার তেল ছাড়তে পারছে না?
ভারতের ১.৪ বিলিয়ন মানুষের জন্য বিপুল পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন। দেশটির অভ্যন্তরীণ উৎপাদন চাহিদার মাত্র ২০% পূরণ করতে পারে, বাকি ৮০% আমদানি করতে হয়। বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল ব্যবহারকারী দেশ ভারত, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে চীনকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাশিয়া বর্তমানে ভারতের অপরিশোধিত তেলের ৩৬% সরবরাহ করে, যা দেশটির সবচেয়ে বড় তেল সরবরাহকারী। রাশিয়া ভারী ছাড়ে তেল বিক্রি করছে, যা মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য সরবরাহকারীরা দিচ্ছে না। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা ভারতের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে।
বিকল্প কোথায়?
ভারত অতীতে ইরান ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশের ওপর নির্ভর করত, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন সেসব পথ বন্ধ। তাই রাশিয়ার সস্তা তেলই এখন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাতারাতি রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করলে ভারতের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খাবে। শুধু তাই নয়, এতে বিশ্ববাজারে তেলের দামও হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে- যার প্রভাব আমেরিকার ভোক্তারাও অনুভব করবেন।
ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনে নিজ দেশে পরিশোধন করে পরিশোধিত তেলপণ্য রপ্তানি করে- এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপেও। কারণ, রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল সরাসরি নিষিদ্ধ হলেও তৃতীয় দেশ থেকে পরিশোধিত পণ্য নিষিদ্ধ নয়।
২০২৩ সালে ভারত ৮৬ বিলিয়ন ডলারের পরিশোধিত তেলপণ্য রপ্তানি করেছে, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই লাভের বড় অংশই এসেছে রাশিয়ার তেল ব্যবহার করে।
রাশিয়া-ভারত সম্পর্ক
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। শীতল যুদ্ধের সময় থেকে এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে, বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানায়। রাশিয়া ভারতকে সামরিক সহায়তা ও অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে। আজও ভারত রাশিয়ার অস্ত্রের অন্যতম প্রধান ক্রেতা।
যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের কাছ থেকেও অস্ত্র কেনা বাড়িয়েছে, তবে রাশিয়া এখনো ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও কৌশলগত অংশীদার।
মোদি-ট্রাম্প সম্পর্ক কি টিকবে?
মোদি ও ট্রাম্প অতীতে একে অপরকে ‘বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ২০১৯ সালের এক সমাবেশে ট্রাম্প একবার বলেছিলেন, ‘ভারতের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ভালো বন্ধু আর কেউ ছিল না।’
কিন্তু বর্তমানে দু’জনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে দূরত্ব।
ভারত ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকিকে ‘অযৌক্তিক’ ও ‘একতরফা’ বলছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং চাপে ভারত মাথা নত করবে না বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
আপনার মতামত লিখুন :