বুধবার, ০৮ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আল-জাজিরা

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২৫, ০৭:৫৪ পিএম

নির্বাচনের আগে বিহারে মুসলিমবিরোধী ভীতি ছড়াচ্ছে বিজেপি

আল-জাজিরা

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২৫, ০৭:৫৪ পিএম

ছবি- সংগৃহীত

ছবি- সংগৃহীত

প্রায় এক দশক আগে পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা কিষাণগঞ্জের একটি সরকারি স্কুলে পড়তেন মুখতার আলম। সনাতন ধর্মালম্বী সহপাঠীদের সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বিশেষ করে এক বন্ধুর সঙ্গে পড়াশোনা, প্রজেক্ট, খাওয়া-দাওয়া সবই হতো। মুখতার নিজে মাংস খেতেন না, যাতে তার নিরামিষভোজী বন্ধু অস্বস্তিতে না পড়ে। কিন্তু বছর দশেক পর সেই বন্ধুত্বের ভিত্তিই কেঁপে ওঠে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক মন্তব্যের কারণে।

সম্প্রতি বিহারের সাহেব মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির মিত্র জিতনরাম মাঁঝি কিষাণগঞ্জে এক সমাবেশে বলেন, ‘শেরশাহবাদী মুসলিমরা আসলে বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী।’ বাংলাদেশে ৯১ শতাংশের বেশি মুসলমান ও প্রধান ভাষা বাংলা ইঙ্গিত করে তিনি দাবি করেন, ‘এদের উৎস সীমান্তের ওপারেই’।

‘শেরশাহবাদী’ নামটি এসেছে ঐতিহাসিক শেরশাহবাদ অঞ্চল থেকে, যার মধ্যে রয়েছে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের অংশও। ওই নামের উৎস আফগান বংশোদ্ভূত শেরশাহ সুরির নাম থেকে। তিনি ষোড়শ শতকে মুঘলদের পরাজিত করে অল্প সময়ের জন্য বিহার ও বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) বিশাল অঞ্চল শাসন করেন।

বিহারে হিন্দি ও উর্দুর পাশাপাশি শেরশাহবাদী মুসলিমরা কথা বলেন এমন এক মিশ্র উপভাষায়, যাতে বাংলার সঙ্গে হিন্দি-উর্দুর মিশ্রণ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় ‘বাদিয়া’ বা ‘ভাটিয়া’, যা এসেছে ‘ভাটো’ শব্দ থেকে। অর্থ নদীর উজান। কারণ ঐতিহাসিকভাবে এ জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষরা গঙ্গা নদীর উজান বরাবর পশ্চিমবঙ্গের মালদা ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে বিহারের সীমাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন।

ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক শেরশাহবাদী মুসলিম মুখতার বলেন, ‘মাঁঝির সেই বক্তব্য শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম’। তিনি চুপ থাকেননি, ফেসবুকে প্রতিবাদ জানালেন। কিন্তু সেখানে মন্তব্যে ভেসে উঠল, ‘তোমরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ আর এই মন্তব্য করেছিলেন তার সেই প্রিয় বন্ধুই। স্মৃতিচারণ করে মুখতার বলেন, ‘ওটা পড়ে আমার মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, ওই এক কথাই বন্ধুত্বের মাঝে দেয়াল তুলে দিল।’

২০২৩ সালে প্রকাশিত বিহার রাজ্যের বর্ণ আদমশুমারি অনুযায়ী, রাজ্যে প্রায় ১৩ লাখ শেরশাহবাদী মুসলিম বাস করেন। মূলত কিষাণগঞ্জ ও কাটিহার জেলায় এই সংখ্যা বেশি। এখন সেই জেলাগুলো বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দু। কারণ একটাই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ। বিহারে দুই দফায় আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর নির্বাচন হলে ফল ঘোষণা হবে ১৪ নভেম্বর।

১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, দেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করতে ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যাতাত্ত্বিক মিশন’ গঠন করা হবে। তার বক্তব্য, ‘কোনো দেশই অনুপ্রবেশকারীদের হাতে নিজেকে তুলে দেয় না। ভারতও দেবে না।’ তবে কারা এই অনুপ্রবেশকারী, তা তিনি স্পষ্ট করেননি।

হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বহুদিন ধরেই ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটি ব্যবহার করে বাংলাভাষী মুসলমানদের নিশানা করে আসছে। বিশেষত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে। আসামে ইতোমধ্যে বিজেপি সরকার বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বহিরাগত’ বলে অভিযুক্ত করে জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের অভিযোগ তুলেছে। ভারতের মুসলমান জনসংখ্যার দিক থেকে আসাম তৃতীয় স্থানে অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।

বিহারে মুসলমানের সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ (মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ)। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সীমাঞ্চল অঞ্চলে বসবাস করে, যা পশ্চিমবঙ্গের সীমানার একদম পাশে আর বাংলাদেশের সীমান্ত সেখান থেকে কেবল কয়েক কিলোমিটার দূরে।

উত্তর ভারতের এই রাজ্যে বিজেপি কখনো একা সরকার গঠন করতে পারেনি। সব সময় আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোটে শাসন করেছে। সমালোচকদের মতে, সীমাঞ্চল নিয়ে বিজেপির নতুন প্রচারণা ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী তত্ত্ব’ আসলে ভোটের মেরুকরণের কৌশল।

আলম বলেন, ‘দুই বছর ধরে ভয় বাড়ছে, কারণ এখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আমাদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এমন ভাষা ব্যবহার করছেন।’ গত বছর পূর্ণিয়ায় মোদি বলেছিলেন, ‘সীমাঞ্চল এখন অনুপ্রবেশের কেন্দ্র, এর ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে।’ সাম্প্রতিক সমাবেশেও তিনি বলেন, ‘প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে বের করে দেব।’

‘বাংলাদেশ থেকে রাক্ষস এসেছে’

শুধু বক্তৃতা নয় বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে চলছে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করার অভিযান। আসাম, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও নয়াদিল্লি থেকে শত শত বাংলাভাষীকে বহিষ্কার করা হয়েছে, যদিও অনেকের কাছেই ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ নথি রয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, অভিযানটি মূলত মুসলিমদের লক্ষ্য করে।

সম্প্রতি বিজেপির আসাম শাখা একটি এআই-নির্ভর ভিডিও প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘বিজেপি ছাড়া আসাম’। সেখানে দাবি করা হয়, মুসলিম জনসংখ্যা শিগগিরই ৯০ শতাংশে পৌঁছবে, তারা রাজ্যের সব ক্ষেত্র দখল করবে, গরুর মাংস বৈধ করবে ইত্যাদি।

অন্যদিকে বিহারের নেতারা আরও উগ্র ভা0ষায় বক্তব্য দিচ্ছেন। বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং পূর্ণিয়ায় বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনেক রাক্ষস এসেছে; আমাদের তাদের হত্যা করতে হবে।’ তিনি আগেও সীমাঞ্চলে ‘হিন্দু গর্ব মার্চ’ আয়োজন করেছিলেন, যেখানে মুসলমানদের লক্ষ্য করে ‘লাভ জিহাদ’ ও ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ’ ইস্যু তোলা হয়।

কিষাণগঞ্জে এক সমাবেশে গিরিরাজ বলেছিলেন, ‘যদি বাদিয়া বা অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের একবার চড় মারে, আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের হাজার বার চড় মারব।’ ভিড় তখন উল্লাসে ফেটে পড়ে।

বিজেপি বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, ‘এটা মেরুকরণ নয়, বাস্তব সত্য। অনুপ্রবেশে সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে। ২০-২৫ বছরের মধ্যে সীমাঞ্চল বাংলাদেশে পরিণত হবে।’

কিন্তু টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের প্রাক্তন অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র বলছেন, ‘সীমাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কোনো প্রমাণ নেই। সীমাঞ্চলের তো বাংলাদেশের সঙ্গে সীমানাই নেই।’

বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ তকমা দেওয়া শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে আসামে। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে বিহারে। ১৯৮০-এর দশকে আরএসএস-ঘনিষ্ঠ ছাত্র সংগঠন এবিভিপি দাবি করে যে, সীমাঞ্চলে ২০ হাজার বাংলাদেশি ভোটার তালিকায় ঢুকে পড়েছে।

১৯৮৩ সালে নির্বাচন কমিশন তাদের অভিযোগের পর্যালোচনা করে ৬ হাজার মুসলিমকে নোটিশ দেয় নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য, তাদের সবাই ছিলেন শেরশাহবাদী মুসলিম। কিন্তু স্থানীয় কর্মীদের প্রচেষ্টায় প্রমাণিত হয় সবাই বৈধ নাগরিক। একটিও নাম বাতিল হয়নি।

এখন সেই ইতিহাস যেন আবার ফিরে আসছে। বিজেপির নেতা নিশিকান্ত দুবে সংসদে বলেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশে সীমাঞ্চলের জনসংখ্যা বদলে গেছে, তাই এনআরসি চালু করতে হবে।’ আসামের মতোই সীমাঞ্চলেও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের দাবি তুলছেন বিজেপি নেতারা।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন পরিচালিত বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) কার্যক্রমে বিহারের ৮ কোটি ভোটারের প্রায় ৬ শতাংশের নাম বাদ পড়েছে। মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ কিষাণগঞ্জে বাদ পড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ ভোটার, যা রাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার।

বিজেপি নেতা চৌধুরী দাবি করেন, ‘বাংলাদেশিরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে বলেই এত আবেদন পড়েছে।’ কিন্তু নির্বাচন কমিশন পরে জানায়, বাদ পড়া ভোটারদের বেশিরভাগই মৃত, স্থানান্তরিত বা দ্বৈত তালিকাভুক্ত ছিলেন। কাটিহারের শেরশাহবাদী বাসিন্দা আকবর ইমাম বলেন, ‘আমাদের বাড়িঘর নিয়ে ইতোমধ্যেই হিন্দুদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। যদি আমাদের তাড়ানো হয়, কারা দখল করবে।’

রাজনৈতিক এই তপ্ত আবহে সীমাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও গভীর হচ্ছে। স্থানীয় শিক্ষক তাফহিম রহমান জানান, তার স্কুলে এক দশক আগেও ১৬ শতাংশ হিন্দু ছাত্র ছিল, এখন মাত্র ২ শতাংশ। তিনি বলেন, ‘ধনী মুসলমানরাও এখন মিশ্র স্কুল থেকে সন্তানদের সরিয়ে নিচ্ছেন। এই দূরত্বই ভয়াবহ, ধীরে ধীরে ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাকে স্বাভাবিক করে তুলছে।’

কিষাণগঞ্জের এক হাসপাতালের মালিক আজাদ আলম বলেন, ‘হিন্দু রোগীরা এখন মুসলিম চিকিৎসকের কাছে যেতে দ্বিধা করেন, বিশেষ করে শেরশাহবাদীদের কাছে।’ তবে সবাই এমন নন। স্থানীয় হিন্দু ব্যবসায়ী অজয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘আমি হিন্দু, কিন্তু আমার ৯০ শতাংশ গ্রাহক মুসলমান। মুসলিম ছাড়া হিন্দু ব্যবসা টেকে না। রোগ হলে আমি ডাক্তারের ধর্ম দেখি না, দেখি দক্ষতা।’

বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদিল হোসেন বলেন, ‘উন্নয়ন সমস্যাকে নিরাপত্তা সমস্যায় রূপান্তর করার এক সমন্বিত প্রচেষ্টা চলছে। এতে সাধারণ মানুষ উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায় ভুগছে।’

কিষাণগঞ্জে ফিরে মুখতার আলম বলেন, ‘প্রতিবার নির্বাচনের আগে আমাদের নিয়ে রাজনীতি হয়। বারবার প্রমাণ দিতে হয় আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। ভয় আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে।’ তার চোখ আকাশের দিকে স্থির, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আরও বলেন, ‘একজন শেরশাহবাদী মুসলিম হিসেবে ওই মন্তব্যগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খায়... একেবারে ভূতের মতো।’

Link copied!