ঢাকা মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর, ২০২৫

উট ও সোনার ব্যবসা থেকে

অর্ধেক সুদানের অধিপতি কে এই হেমেদতি

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৫, ০৪:১৯ পিএম
মোহাম্মদ হামদান দাগালো। ছবি- সংগৃহীত

একসময় পরিচিত ছিলেন উট ব্যবসায়ী হিসেবে। বর্তমানে তিনি সুদানের ক্ষমতার অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। তার নেতৃত্বাধীন র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) এখন দেশের প্রায় অর্ধেক অংশের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্প্রতি দারফুর অঞ্চলের শেষ সরকারি ঘাঁটি এল-ফাশের দখল করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করেছে আরএসএফ। 'হেমেদতি' নামেই বেশি পরিচিত এই ব্যক্তির প্রকৃত নাম মোহাম্মদ হামদান দাগালো। 

শত্রুদের কাছে হেমেদতি এক আতঙ্কের নাম হলেও, তার অনুসারীরা তাকে দেখে দৃঢ়তা, কঠোরতা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে ফেলার প্রতিশ্রুতির প্রতীক হিসেবে। ১৯৭৪ বা ১৯৭৫ সালে দারফুরের এক যাযাবর পরিবারে জন্ম হেমেদতির। তার পরিবার মহারিয়া শাখার রিজেইগাত সম্প্রদায়ের, যারা ঐতিহ্যগতভাবে উট পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে।

দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা হেমেতি কৈশোরেই স্কুল ছেড়ে উট বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হন, লিবিয়া ও মিসরের মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পণ্য বেচাকেনা করতেন। সে সময় দারফুর ছিল এক অবহেলিত, দরিদ্র ও আইনশৃঙ্খলাহীন অঞ্চল, যা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সরকারের নজর এড়িয়ে ছিল।

এই প্রেক্ষাপটে দারফুরে শুরু হয় জাতিগত সংঘাত। ২০০৩ সালে ফুর জাতিগোষ্ঠী বিদ্রোহ শুরু করলে, বশির সরকার আরব মিলিশিয়া বাহিনী 'জানজাওয়িদ'কে বিদ্রোহ দমনে পাঠায়। হেমেদতিও তার একটি ইউনিটের নেতৃত্ব দেন। এই জানজাওয়িদ বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া, লুটপাট, ধর্ষণ ও হত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধের অভিযোগ ওঠে। 

আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৪ সালে হেমেদতির ইউনিট দারফুরের আদওয়া গ্রামে হামলা চালিয়ে ১২৬ জনকে হত্যা করে। মার্কিন তদন্তে জানজাওয়িদদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও ওঠে। তবে তখন হেমেদতি ছিলেন তুলনামূলকভাবে নিচের সারির কমান্ডার, তাই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)-এর তদন্তের আওতায় আসেননি।

সংঘর্ষের বছরগুলোতে হেমেতি অত্যন্ত কৌশলে নিজের অবস্থান শক্ত করেন। একসময় তিনি পরিচিতি পান শক্তিশালী আধাসামরিক বাহিনীর প্রধান, এক কর্পোরেট সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে। বিদ্রোহের মাধ্যমে সেনা সদস্যদের বকেয়া বেতন, পদোন্নতি ও ভাইয়ের জন্য রাজনৈতিক পদ দাবি করে তিনি বশিরের সমর্থন অর্জন করেন।

এরপর দারফুরের সবচেয়ে বড় স্বর্ণখনি 'জাবেল আমির'-এর নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান 'আল-গুনেইদ'কে সুদানের বৃহত্তম স্বর্ণ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন।

২০১৩ সালে হেমেদতি আনুষ্ঠানিকভাবে র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, যা সরাসরি প্রেসিডেন্ট বশিরের অধীনে কাজ করত। জানজাওয়িদ বাহিনীকে আরএসএফের সঙ্গে একীভূত করে নতুন পোশাক, যানবাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও সেনা কর্মকর্তাদের সহায়তা দেওয়া হয়।

আরএসএফ শুধু দারফুরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দক্ষিণ সুদানের নুবা পর্বতমালায় বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হলেও লিবিয়া সীমান্তে মানবপাচার রোধের নামে চাঁদাবাজি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) সুদানের সেনা পাঠানোর অনুরোধ করলে হেমেদতি সুযোগটি কাজে লাগান। 

তিনি সৌদি আরব ও ইউএই’র সঙ্গে পৃথক চুক্তি করে তার বাহিনীর সদস্যদের ভাড়াটে সেনা হিসেবে পাঠাতে শুরু করেন। বিশেষ করে আবুধাবির সঙ্গে এই সম্পর্ক তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

টাকার প্রলোভনে অসংখ্য তরুণ সুদানি, এমনকি প্রতিবেশী দেশের যুবকরাও আরএসএফ-এ যোগ দেয়। এরপর তিনি রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গেও অংশীদারিত্ব গড়ে তোলেন, যার বিনিময়ে আরএসএফ প্রশিক্ষণ এবং স্বর্ণসহ নানা বাণিজ্যিক চুক্তিতে জড়িয়ে পড়ে।

২০১৯ সালে বশির সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ তীব্র হলে, বশির হেমেদতির ইউনিটগুলোকে রাজধানী খারতুমে মোতায়েনের নির্দেশ দেন। বশির ভেবেছিলেন, আরএসএফ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান ঠেকানোর জন্য এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে। 

কিন্তু তার এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। বশির সেনাবাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে, সেনাপ্রধানদের বৈঠকে হেমেদতিসহ অন্যান্য কমান্ডাররা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেন।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হেমেদতিকে একসময় সুদানের ভবিষ্যৎ রাজনীতির নতুন মুখ হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছিল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই হেমেদতি ও অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক পরিষদের যুগ্মপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান বেসামরিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত করতে থাকেন। 

ফলস্বরূপ, গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন আরও জোরদার হলে হেমেদতি তার আরএসএফ বাহিনীকে বিক্ষোভ দমনে নামান। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আরএসএফ সদস্যরা শত শত মানুষকে হত্যা করে, নারী ধর্ষণ করে এবং পুরুষদের নীলনদে ফেলে দেয়। হেমেদতি অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

পরে আন্তর্জাতিক চাপে দুই বছর ধরে সুদানে সামরিক প্রভাবাধীন সার্বভৌম পরিষদ ও বেসামরিক মন্ত্রিসভার মধ্যে টালমাটাল সহাবস্থান চলে। তবে মন্ত্রিসভার গঠিত একটি তদন্ত কমিটি সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা সংস্থা ও আরএসএফের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর আর্থিক লেনদেনের ওপর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করার ঠিক আগেই বুরহান ও হেমেদতি যৌথভাবে বেসামরিক সরকারকে বরখাস্ত করে ক্ষমতা দখল করেন।

তবে এই জোট স্থায়ী হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই বুরহান আরএসএফকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি জানালে হেমেদতি তাতে রাজি হননি। 

২০২৩ সালের এপ্রিলে আরএসএফ রাজধানী খারতুমে সেনা সদর দপ্তর ঘিরে ফেলে এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও জাতীয় প্রাসাদ দখলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয় এবং খার্তুম ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। 

দারফুরেও নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে আরএসএফ বাহিনী স্থানীয় মাসালিত জনগোষ্ঠীর ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন চালায়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এ সংঘাতে ১৫ হাজার পর্যন্ত বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাযজ্ঞকে 'গণহত্যা' হিসেবে বর্ণনা করেছে।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ অস্বীকার করলেও, আরএসএফ কমান্ডাররা তাদের সদস্যদের নির্মম নির্যাতন ও হত্যার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়, যেন এসব অপরাধ তাদের জন্য গৌরবের বিষয়। আরএসএফ ও এর মিত্র মিলিশিয়া সুদানজুড়ে শহর, বাজার, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল লুটপাট করে। লুট করা পণ্য বিক্রি হচ্ছে 'দাগালো মার্কেট'-এ, যা প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।

যুদ্ধের প্রথম দিকে রাজধানীর জাতীয় প্রাসাদে গোলা ও বিমান হামলার মধ্যে হেমেদতি গুরুতর আহত হন এবং জনসমক্ষে থেকে অন্তর্ধান করেন। কয়েক মাস পর পুনরায় প্রকাশ্যে এলেও তিনি যুদ্ধাপরাধ বা হত্যাযজ্ঞ নিয়ে কোনো অনুশোচনা দেখাননি, বরং যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভের সংকল্প আরও দৃঢ় করেন। 

আরএসএফ বর্তমানে অত্যাধুনিক অস্ত্রের অধিকারী, যার মধ্যে উন্নতমানের ড্রোনও রয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব অস্ত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের নির্মিত এক বিমানঘাঁটি ও সরবরাহকেন্দ্র হয়ে চাদ সীমান্তের ভেতর দিয়ে সুদানে প্রবেশ করছে।

হেমেদতি বর্তমানে রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন, যার মধ্যে রয়েছে কিছু বেসামরিক গোষ্ঠী ও সশস্ত্র আন্দোলন। তিনি নিজেকে চেয়ারম্যান করে 'গভর্নমেন্ট অব পিস অ্যান্ড ইউনিটি' নামে একটি বিকল্প প্রশাসনও গঠন করেছেন। এল-ফাশের দখলের পর নীলনদের পশ্চিমে বসবাসযোগ্য প্রায় সব অঞ্চল এখন আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে।

সুদানি বিশ্লেষকদের ধারণা, হেমেদতির এখন দুটি সম্ভাব্য লক্ষ্য রয়েছে— তিনি হয়তো নিজেকে একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান, অথবা এখনো পুরো সুদানের শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। 

আরেকটি সম্ভাবনা হলো, তিনি নিজেকে এমন এক সর্বশক্তিমান ক্ষমতার কেন্দ্রে দেখতে চান, যিনি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, ভাড়াটে বাহিনী এবং রাজনৈতিক দল—এই তিনেরই নিয়ন্ত্রণ রাখবেন। সেই অবস্থায়, তিনি হয়তো দেশের মুখ হয়ে না উঠলেও আড়াল থেকে সুদানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন।

এল-ফাশেরের রাস্তায় তার বাহিনী যখন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছে, হেমেদতি তখনো আত্মবিশ্বাসী। তার ধারণা, এই নিষ্ঠুরতা থামাতে আন্তর্জাতিক বিশ্বের আসলে খুব একটা আগ্রহ নেই।