ঢাকা মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর, ২০২৫

চিন্তার জগৎকে শূন্য করে দিচ্ছে এআই

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৫, ০৮:৪৬ পিএম
ছবি- সংগৃহীত

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যখন বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করছে, তখন প্রশ্ন উঠছে—মানুষের স্বাভাবিক, জটিল ও সৃজনশীল চিন্তার ভবিষ্যৎ কোথায়? ক্রমবর্ধমান এআই-নির্ভরতা কি আমাদের চিন্তার জগৎকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে?

মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) প্রকাশিত জিও নিউজের এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়, লেখালেখি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা সমস্যা সমাধানে মানুষের পরিবর্তে এআই ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। এর ফলে ধীরে ধীরে মানুষের স্বাধীন চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি ক্ষয় হচ্ছে—যা এক নীরব বুদ্ধিবৃত্তিক মৃত্যুকেই ইঙ্গিত দেয়।

কী হারাচ্ছে মানুষ

বিশ্বখ্যাত ভবিষ্যৎবিদ ও দ্য ফিউচার্স এজেন্সির প্রধান নির্বাহী গার্ড লিওনার্ড মনে করেন, যখন আমরা এআই-এর দেওয়া উত্তরের ওপর যাচাই না করেই নির্ভর করি, তখন আমরা চিন্তা করা বন্ধ করে দেই। নিজের বুদ্ধি প্রয়োগের অভ্যাস হারিয়ে ফেলি, যা মানব মস্তিষ্কের জন্য এক গুরুতর ঝুঁকি। ইন্টারনেট মানুষকে কিছুটা অলস করেছিল, কিন্তু এআই সেই প্রবণতাকে হাজারগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদি আমরা এটি চিন্তার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করি, তবে আমাদের মস্তিষ্ক নিস্তেজ হয়ে পড়বে।

লেবাননের কৌশলগত যোগাযোগ ও মিডিয়ায় এআই বিশেষজ্ঞ ড. স্যালি হাম্মুদ বলেন, মানুষ অলসতা পছন্দ করে। তাই প্রযুক্তি ধীরে ধীরে আমাদের চারপাশ দখল করে নিয়েছে। তবে যদি এআই একঘেয়ে কাজগুলো করে দেয়, তাহলে মানুষের আরও সময় পাওয়া উচিত সৃজনশীলতার দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য। মানুষকে এআই-এর সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে, তবে এমনভাবে যাতে এআই আমাদের সৃজনশীলতাকে বাড়ায়।

হুমকিতে সম্পর্ক ও স্বাধীনতা

জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাসটেইনেবল এআই ল্যাব-এর গবেষক ড. থমাস মেটকাফ বলেন, যদি এআই আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও সম্পর্কের জায়গাগুলো দখল করে নেয়, তাহলে মানব সমাজ এক অচেনা ভবিষ্যতের দিকে যাবে। মানুষ তখন সম্পর্কের আগে ‘অপটিমাল’ সিদ্ধান্তের কথা ভাববে। কল্পনা করুন, সন্তানকে জড়িয়ে ধরার আগে কেউ এআই-এর পরামর্শ নিচ্ছে, এটা কি স্বাভাবিক মানবিক আচরণ?

ড. মেটকাফ মনে করেন, এআই সরাসরি মানুষের স্বাধীনতাকে হুমকিতে না ফেললেও তা ধীরে ধীরে কল্পনা ও ভুল করার ক্ষমতাকে খর্ব করছে। যদি আমরা সব সিদ্ধান্ত এআই-এর ওপর ছেড়ে দিই, তাহলে নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলব।

পাল্টে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের মানসিক গঠন

গার্ড লিওনার্ড বলেন, নতুন প্রজন্ম এআই-কে ‘ডিফল্ট বাস্তবতা’ হিসেবে গ্রহণ করছে। তারা যখন স্ক্রিনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে, তখন বাস্তব মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কিছু না করেও সবকিছু করার অনুভূতি এক ধরনের মানসিক অলসতা তৈরি করছ, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবের চেয়েও বিপজ্জনক। এআই এখন মানুষের জন্য অর্থ তৈরি করছে, ব্যাখ্যা দিচ্ছে, যা ধীরে ধীরে সত্য ও জ্ঞানের সংজ্ঞাকেও বদলে দিচ্ছে।

অসম্পূর্ণতাই সৃজনশীলতার সৌন্দর্য

ড. মেটকাফ বলেন, মানুষের সৃজনশীলতার বিশেষত্ব হলো সর্বোচ্চ উৎকর্ষতার পথে অবিরাম চলা । মেশিন নিখুঁত হতে পারে, কিন্তু মানুষের অসম্পূর্ণতার মধ্যেই থাকে আসল সৌন্দর্য। যখন কেউ চোখ বেঁধে ছবি আঁকে বা বালুকণায় নকশা তৈরি করে, তখন আমরা মুগ্ধ হই, কারণ অসম্পূর্ণ প্রক্রিয়াতেও সে কিছু চমকপ্রদ সৃষ্টি করে। এটাই মানুষকে আলাদা করে।

মৌলিক চিন্তার সংকট

লিওনার্ড সতর্ক করেন, আমরা যেন মেশিনের মতো চিন্তা করতে শুরু না করি। অ্যালগরিদমভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে মানবিক চিন্তার বহুমাত্রিকতা হারিয়ে যেতে পারে।

ড. হাম্মুদ বলেন, এআই ধীরে ধীরে আমাদের দক্ষতা কমিয়ে দিচ্ছে। এটি এমন এক বুদ্ধিমত্তা তৈরি করছে যাকে আমি বলি ‘এলিয়েন ইন্টেলিজেন্স’। যেখানে মানুষ মেশিনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, উল্টোটা নয়। যদি আমরা মেশিন থেকে শেখা শুরু করি, তাহলে নতুন জ্ঞান তৈরি নয়, শুধু পুরোনো জ্ঞান পুনরুৎপাদন করব। মানব সৃজনশীলতা তখন কেবল নকলের পর্যায়ে নেমে আসবে।

থেকে যায় প্রশ্ন

ড. মেটকাফ পরামর্শ দেন, মানুষকে নিজেদের জিজ্ঞাসা করতে হবে কোন দক্ষতাগুলো হারাতে রাজি, কীভাবে নিজেদের মানবিকতা সংজ্ঞায়িত করছি, এবং কীভাবে আমরা ভবিষ্যতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাই।

অন্যদিকে লিওনার্ড মনে করেন, এআই মানবজাতির অনেক বাস্তব সমস্যা সমাধান করতে পারে, যেমন- স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু সংকট, বা তথ্যপ্রবাহের উন্নয়ন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকে যায়; আমরা কী চাই? সমতা ও শান্তি, না কি সর্বাধিক মুনাফা? এই প্রশ্নটাই এখন এআই আমাদের সামনে রাখছে, নুষ ও পৃথিবী কি একসঙ্গে উন্নতি করবে, নাকি প্রযুক্তি কেবল অল্প কয়েকজনের সমৃদ্ধির হাতিয়ার হয়ে উঠবে?