চলিত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে ঈদে মিলাদুন্নবী (বারাওয়াফাত) উপলক্ষে আয়োজিত এক ধর্মীয় মিছিল থেকে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা একটি ব্যানার ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মতে এটি নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ হলেও, কিছু হিন্দু গোষ্ঠী এটিকে ঐতিহ্যবিরোধী বলে আপত্তি জানায়। ফলস্বরূপ, পুলিশ হস্তক্ষেপ করে, মামলা হয় এবং প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে।
ঘটনার সূচনা
গত ৪ সেপ্টেম্বর কানপুরের সৈয়দ নগর এলাকায় একটি মিলাদুন্নবী মিছিলে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা ব্যানার ঝুলানো হয়। এটি বহু মুসলিমের কাছে ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ হলেও, স্থানীয় হিন্দু সংগঠনগুলি অভিযোগ করে, ঐতিহ্যবিরোধীভাবে এমন এক স্থানে ব্যানার লাগানো হয়েছে যা সাধারণত হিন্দু উৎসব ‘রাম নবমী’র জন্য ব্যবহৃত হয়। তাদের ভাষায়, এটি ‘নতুন প্রথা চালু করার চেষ্টা’।
প্রশাসনের পদক্ষেপ
বিতর্কের জেরে কানপুর পুলিশ মিছিলে অংশ নেওয়া ২৪ জন মুসলিম যুবকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে। পুলিশ জানায়, ব্যানারের বিষয়বস্তু নয়, বরং অনুমতি ছাড়া নতুন স্থানে তাঁবু ও ব্যানার স্থাপনই ছিল মূল অভিযোগ।
এ ঘটনা নিয়ে পুলিশ কমিশনার অখিল কুমার জানান, ‘স্লোগানের জন্য নয়, বরং স্থান ব্যবহারের নিয়ম ভঙ্গ এবং অন্য ধর্মের পোস্টার ছেঁড়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। তবে যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নেই তাদের নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হবে।’
প্রতিবাদ
পুলিশ ও স্থানীয়দের হিন্দুদের এমন আচরণের পরই স্থানীয় মুসলমানরা কানপুর থেকে প্রতিবাদ শুরু করে বেরেলি, লখনউ, মহারাজগঞ্জসহ উত্তরপ্রদেশের বহু জেলায় এবং মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, গুজরাট, ঝাড়খণ্ডসহ বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায় রাস্তায় নেমে আসে। তারা ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানায়। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোফাইল ছবি বদলে এই স্লোগান ব্যবহার করেন। হ্যাশট্যাগ #ILoveMuhammad ট্রেন্ড করে।
প্রতিবাদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মুসলিমদের প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে গত বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে হিন্দু ধর্মীয় নেতারা ‘আই লাভ মহাদেব’ লেখা পোস্টার হাতে রাস্তায় নামেন। শঙ্করাচার্য নরেন্দ্রানন্দের নেতৃত্বে আয়োজিত এই বিক্ষোভে দাবি করা হয়, মুসলমানদের ‘ভক্তির আড়ালে’ দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র চলছে। তাদের মতে, এটি প্রতীকী প্রতিবাদ– যাতে সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
এদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এই স্লোগান কোনো বিতর্কিত বিষয় নয়, বরং ভক্তিমূলক প্রকাশ বলে মন্তব্য করেছে দেশটির এবং প্রতিবাদে অংশ নেওয়া অনেক মুসলিম নেতা ও সাধারণ মানুষেরা।
এ বিষয়ে ‘সর্বভারতীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদের’ প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান, ‘আমি মুহাম্মদকে ভালোবাসি’ বলা কোনো অপরাধ নয় এবং এটি ভারতের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদের অধীনে রক্ষিত ধর্মীয় স্বাধীনতা। অন্যদিকে মালওয়ানি (মুম্বাই)সহ বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান ধর্মীয় নেতারা পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে থানায় গিয়ে প্রতিবাদ জানান।
এ ঘটনার পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ হলেও কিছু জায়গায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান রয়েছে, তবে কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার ও এফআইআর-এর ঘটনা ঘটে।
উভয় সম্প্রদায়ের যুক্তি
মুসলিমদের যুক্তি হলো, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ইসলামের একটি মৌলিক অনুশীলন। এ নিয়ে রাজ্যের মুসলিমরা দাবি করেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলা কোনোভাবেই উস্কানিমূলক নয়।
অন্যদিকে, হিন্দু সংগঠনগুলো বলছে, ধর্মীয় মিছিল বা ব্যানার ঐতিহ্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে হওয়া উচিত, যাতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় থাকে। প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো- অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি স্থানে দৃশ্যমান কাঠামো স্থাপন আইনবিরুদ্ধ।