জাতিসংঘের খাদ্য অধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত মাইকেল ফাখরি বলেছেন, ‘‘গাজার দুর্ভিক্ষ একটি ‘মানবসৃষ্ট’ দুর্ভিক্ষ। আমরা এখন গাজায় যা দেখছি তা হলো ‘ইসরায়েলি’ অনাহার অভিযানের সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়। খাদ্য সংগ্রহ করতে যাওয়া বেসামরিক নাগরিকদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে তেল আবিব।’’
গত মার্চ মাসে ‘ইসরায়েলি’ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা উপত্যকায় খাদ্য ও ত্রাণ প্রবেশের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই অবরোধ স্থায়ী থাকলেও পরবর্তীতে সীমিত পরিসরে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে ফাখরি বলেন, ‘এটি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি, যেখানে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইনের দৃষ্টিতে শুধু খাদ্যের সংকটই নয়, বরং পানি ও স্বাস্থ্যসেবা থেকেও তারা বঞ্চিত। আর যেটা জানি, তা হলো এটি মূলত যুদ্ধাপরাধ।’
এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, গত মার্চ মাস থেকে ‘ইসরায়েল’ কেবল সামান্য খাদ্য এবং মানবিক সাহায্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়ায় গাজার ১০ লাখের বেশি শিশু ক্ষুধার্ত অবস্থায় রয়েছে।
অপুষ্টিতে ভোগা এক শিশুর মা আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা আশা করি, শিশুদের জন্য ফর্মুলা ও ডায়াপার প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। এবং ক্রসিং খুলে দিলে অবরুদ্ধ উপত্যকায় খাবার ভেতরে আসতে পারে। আমরা বাচ্চাদের কষ্ট পেতে দেখি, মা হিসেবে আমদেরও কষ্ট হয়।’
লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জীবন রক্ষাকারী দাতব্য কিচেনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে মানুষ অবশিষ্ট ডালের ভাগভাগি নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে বাধ্য হচ্ছে।
কিছু ডালভর্তি ব্যাগ হাতে একজন ফিলিস্তিনি নারী বলেন, ‘এটা কি খাওয়ার যোগ্য? এটা কি খাওয়ার যোগ্য? আমার বাচ্চাদের খাওয়াতে হবে। এটা কি খাওয়ার যোগ্য? মানুষ, আমাদের প্রতি দয়া করুন। আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া করুন।’
আহমেদ আবেদ নামে একজন বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি আল জাজিরাকে জানান, তিনি তার ক্ষুধার্ত সন্তানদের কী বলবেন তা ভেবে হতাশ। তিনি বলেন, ‘কিছুই নেই, খাবার নেই, পানি নেই। আমরা জানি না, বাচ্চাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়। যখন তারা খাবার চাইবে তখন আমরা তাদের কী বলব?’
ওয়ার চাইল্ড বেসরকারি সংস্থার হর্যাচে কাউন্ডারজিয়ান মঙ্গলবার (২২ জুলাই) মধ্য লন্ডনে ‘রেড লাইন ফর গাজা’ প্রতিবাদে সমাবেশ থেকে জানান, আমি মনে করি আপনি ১৭ হাজার শিশু নিহত এবং আরও লাখ লাখ আহত হওয়ার পরিসংখ্যান সম্পর্কে কথা বলতে পারেন।
তিনি জানান, গতকাল আমি একজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, যিনি গাজা সফর করেছিলেন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক মিনিট পরে বোমা বিধ্বস্ত গর্তের জায়গায় শিশুদের খেলার কথা বলেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘সহিংসতা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে বেসামরিক নাগরিকরা এটিকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।’
গত বছর ওয়ার চাইল্ডের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গাজার প্রায় ৯৪ শতাংশ শিশু মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে; প্রায় অর্ধেকই মৃত্যুদশায়। যুদ্ধের সময় শিশু হওয়ার জন্য এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ জায়গা; এটি একেবারেই ভয়াবহ। পরিস্থিতির অবিলম্বে সমাধান করা প্রয়োজন।
কাউন্ডারজিয়ান বলেন, ‘সাধারণত, একটি সংঘাতের সময় আমরা প্রায় ২০ শতাংশ শিশুকে কোনো-না-কোনো স্তরের মানসিক আঘাতের সম্মুখীন হতে দেখি। কিন্তু গাজার বেলায় এক্কেবারে ব্যতিক্রম, প্রতিটি শিশুই এর শিকার। দেড় বছরের মধ্যে সৃষ্ট এই সমস্যা সমাধানে কয়েক দশক সময় লাগবে। এটি কেবল মৌলিক চাহিদাই নয়, বরং সেখানকার মানুষ যে বিশাল মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে তা মোকাবিলা করার জন্য একটি চলমান বিশাল মানবিক প্রতিক্রিয়া হতে চলেছে।’