ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল: জাতিসংঘ

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৫, ০৪:০৭ পিএম
গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। ছবি- সংগৃহীত

গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের একটি তদন্ত কমিশন। মঙ্গলবার প্রকাশিত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক আইনে সংজ্ঞায়িত পাঁচটি গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে চারটির যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: একটি গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা, তাদের গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা, ইচ্ছাকৃতভাবে গোষ্ঠীটিকে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিত পরিস্থিতি তৈরি করা এবং জন্ম রোধ করা। কমিশন বলছে, ইসরায়েলি নেতাদের বক্তব্য এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের ধরন থেকেই গণহত্যার উদ্দেশ্য স্পষ্ট। মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যম বিবিসি জাতিসংঘের এই তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন তুলে ধরেছে।

অন্যদিকে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদনকে ‘বিকৃত ও মিথ্যা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। মন্ত্রণালয়ের দাবি, তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল হামাসের ‘প্রক্সি’ হিসেবে কাজ করেছে এবং ‘হামাসের মিথ্যা প্রচারণা’র ওপর নির্ভর করেছে, যা ইতোমধ্যেই খণ্ডন করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ‘বাস্তবতা হলো হামাসই ইসরায়েলে গণহত্যার চেষ্টা করেছিল—১ হাজার ২০০ জনকে হত্যা করেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে, পরিবারগুলোকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে এবং সব ইহুদিকে হত্যা করার ঘোষণাও দিয়েছে।’

এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে অন্য কোনো দেশ এতটা সতর্ক থেকে বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি এড়ানোর চেষ্টা করেনি।’

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হওয়ার পর গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল।

গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৪ হাজার ৯০৫ জন নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের প্রায় সবাই একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে, ৯০ শতাংশেরও বেশি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে, স্বাস্থ্য, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা গাজা সিটিতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেছেন।

২০২১ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ এই স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনের নেতৃত্ব দেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান নাভি পিল্লাই। অন্যান্য সদস্যরা হলেন অস্ট্রেলিয়ার মানবাধিকার আইনজীবী ক্রিস সিডোটি এবং ভারতীয় আবাসন ও ভূমি অধিকার বিশেষজ্ঞ মিলুন কোঠারি।

কমিশন আগেও বলেছিল, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী যুদ্ধাপরাধ করেছে এবং ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ করেছে।

সর্বশেষ প্রতিবেদনে কমিশন বলছে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ও বাহিনী গণহত্যা কনভেনশনে সংজ্ঞায়িত পাঁচটি কর্মকাণ্ডের মধ্যে চারটি করেছে এবং করছে। এর মধ্যে রয়েছে:

হত্যা: বেসামরিক ও সুরক্ষিত স্থাপনায় হামলা করে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড।

গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি: সরাসরি বেসামরিক জনগণকে লক্ষ্য করে হামলা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, আটক ব্যক্তিদের নিপীড়ন।

ধ্বংসাত্মক জীবনযাত্রার পরিস্থিতি তৈরি: ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো ধ্বংস, চিকিৎসাকেন্দ্র ধ্বংস ও অবরোধ, পানি-বিদ্যুৎ-জ্বালানি বন্ধ রাখা, খাদ্য সহায়তায় বাধা।

জন্ম প্রতিরোধ: ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গাজার বৃহত্তম ফার্টিলিটি ক্লিনিকে হামলা চালিয়ে প্রায় চার হাজার ভ্রূণ ও এক হাজার শুক্রাণু নমুনা ধ্বংস।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট গণহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছেন। কমিশনের দাবি, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ও বাহিনীর কর্মকাণ্ড থেকে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যই একমাত্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা’।

কমিশনের অভিযোগ, ইসরায়েলি বাহিনী ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে নজিরবিহীন সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও আহত করেছে, উপাসনালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সাংস্কৃতিক স্থানে সুসংগঠিত হামলা চালিয়েছে এবং গাজায় অবরোধ আরোপ করে জনগণকে অনাহারে রেখেছে।

যদিও ইসরায়েলি নেতারা দাবি করেন, তাদের অভিযান আত্মরক্ষা এবং হামাসকে পরাজিত করে জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য পরিচালিত।

বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাভি পিল্লাই বলেন, “৭ অক্টোবর থেকেই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন এবং বলেন—‘যেখানে যেখানে হামাস আছে, আমরা সেসব স্থান ধ্বংসস্তূপে পরিণত করব’। তিনি গাজা শহরকে ‘অভিশপ্ত শহর’ আখ্যা দেন এবং সব জায়গায় শক্তভাবে অভিযান চালানো হবে জানিয়ে জনগণকে এলাকা ছাড়তে বলেন।”

কমিশন বলছে, এসব বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের ওপর দায় চাপায়। ফলে ইসরায়েল গণহত্যা প্রতিরোধ ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

এ ছাড়া, কমিশন সতর্ক করেছে যে, অন্যান্য দেশগুলোরও অবিলম্বে গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তারা না করলে সহযোগিতার দায় পড়তে পারে।

প্রতিবেদনের পর কমিশনের তিন সদস্যই পদত্যাগের ঘোষণা দেন। অন্যদিকে ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কমিশনটি বাতিল করার দাবি জানিয়েছে।