চাঁদে মানুষের জন্য স্থায়ী আবাস গড়ে তোলার অংশ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণে তৎপরতা বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা। মার্কিন গণমাধ্যমগুলোর খবরে জানানো হয়েছে, সংস্থাটি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করেছে।
পলিটিকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শন ডাফি জানিয়েছেন, চীন ও রাশিয়াও চাঁদে একই ধরনের প্রকল্পের পরিকল্পনা করছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই দেশ দুটি চাঁদের কিছু অঞ্চলকে ‘নিরাপত্তা এলাকা’ ঘোষণা করতে পারে।
চন্দ্রপৃষ্ঠে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা
চাঁদে নতুন করে শুরু হওয়া বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপানসহ একাধিক দেশ অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি দেশ চাঁদের পৃষ্ঠে স্থায়ী মানব বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে, পারমাণবিক চুল্লি চাঁদে টেকসই শক্তি উৎপাদনের একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায় হতে পারে। চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি দিন প্রায় ১৪ দিন দীর্ঘ, এরপর টানা ১৪ দিনের অন্ধকার নেমে আসে। এই দীর্ঘ অন্ধকার সময়ে সৌরশক্তির ওপর নির্ভরতা চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, যা ঘন ঘন শক্তিচ্যুতি ঘটাতে পারে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের বরাতে জানা গেছে, নাসার অস্থায়ী প্রধান শন ডাফি অন্তত ১০০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি চুল্লি নির্মাণে আগ্রহী। তুলনামূলকভাবে এটি ছোট শক্তি ইউনিট; একটি সাধারণ অনশোর উইন্ড টারবাইন সাধারণত ২-৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে।
আগেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি
পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে চাঁদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারণাটি নতুন নয়। ২০২২ সালে নাসা তিনটি কোম্পানিকে ৫০ লাখ ডলার করে দিয়ে পরীক্ষামূলক ডিজাইন তৈরির কাজ শুরু করেছিল।
এদিকে চীন ও রাশিয়া যৌথভাবে ২০৩৫ সালের মধ্যে চাঁদে একটি স্বয়ংক্রিয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে।
বিজ্ঞানের হলেও রয়েছে রাজনীতি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চাঁদের মতো বৈরী পরিবেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে পারমাণবিক শক্তিই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. সুংউ লিম বলেন, ‘পারমাণবিক শক্তি শুধু কাম্য নয়, এটি অবশ্যম্ভাবী।’
তবে অনেকে এই প্রকল্পের পেছনে বৈজ্ঞানিক চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিওনেল উইলসন জানান, পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত হলে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করবে নাসার আর্টেমিস কর্মসূচির উৎক্ষেপণ সক্ষমতার ওপর।
নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। ওপেন ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. সিমিওন বারবার জানান, তেজস্ক্রিয় পদার্থ মহাকাশে পাঠানোর জন্য বিশেষ অনুমোদন প্রয়োজন, যা সহজ নয়, তবে অসম্ভবও নয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত
নাসা প্রধানের মন্তব্যে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত। ২০২০ সালে স্বাক্ষরিত আর্টেমিস চুক্তির আওতায় চাঁদে অংশীদার দেশগুলো সুরক্ষা অঞ্চল তৈরি করতে পারবে। তবে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এসব অঞ্চল ভবিষ্যতে ‘মালিকানা দাবির’ মতো চেহারা নিতে পারে।
চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি বসানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ বাকি। অর্থায়ন, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের ঘাটতি এই পথের প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
ড. বারবারের ভাষায়, ‘যদি আপনার চুল্লি থাকে, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে সক্ষম যান ও জনবল না থাকে, তবে তা কোনো কাজে আসবে না। এখনো পরিকল্পনাগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত মনে হয় না।’
সূত্র: বিবিসি