সতেরো শতকের শুরুর দিকে ‘পূর্বমুখী নীতি’র বাস্তবায়নে সাইবেরিয়ার মধ্য দিয়ে বেরিং প্রণালি পেরিয়ে উত্তর আমেরিকার উপকূলে পৌঁছে যায় রুশ সাম্রাজ্য। এখনকার যে আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য, সে সময় তা ছিল রাশিয়ার অংশ। কালের বিবর্তনে এই আলাস্কা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আসে। কিন্তু মস্কোর বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ নয়, রক্তপাত নয়, পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় আলাস্কা হস্তান্তর করা হয়। আরও সহজ করে বললে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলাস্কা বিক্রি করে দেয় রাশিয়া। তাও আবার নামমাত্র দামে।
যুক্তরাষ্ট্রও যে আলাস্কা কেনার ব্যাপারে মুখিয়ে ছিল, এমনটা বলা যাবে না। খনিজ সম্পদ থাকলেও দুর্গম, বছরের বেশির ভাগ সময় বরফে ঢেকে থাকা, জনমানবহীন একটি অঞ্চল কিনে কী হবে—মোটাদাগে এমনটাই ছিল ওয়াশিংটনের মনোভাব। যদিও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্য পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ আলাস্কা কিনতে শেষ পর্যন্ত আগ্রহী হয়। অবশেষে ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ আলাস্কা বিকিকিনির চুক্তি করেছিল রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু নিজ দেশের আস্ত একটি ভূখণ্ড কেন বিক্রি করে দিয়েছিল রাশিয়া? তাও আবার খনিজ সম্পদে, বিশেষ করে সোনায় ভরপুর একটি অঞ্চল কেনই বা নামমাত্র দামে ওয়াশিংটনের হাতে তুলে দিয়েছিল মস্কো? কৌতূহলী মানবমনে এমন প্রশ্ন উঁকি দেওয়া স্বাভাবিক, যার উত্তর খুঁজতে যেতে হবে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৮৫৩ সালে ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের সঙ্গে ক্রিমিয়া যুদ্ধে জড়ায় জারশাসিত রাশিয়া। ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের সঙ্গে জোট বেঁধে রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইউরোপীয় শক্তি ফ্রান্স ও ব্রিটেন। ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। হেরে যায় রাশিয়া।
সাম্রাজ্য ও বাণিজ্য বিস্তারের জন্য আলাস্কায় অবস্থান পোক্ত করেছিল রাশিয়া। তবে খনিজসমৃদ্ধ অঞ্চল হলেও খুব কমসংখ্যক রুশ সেখানে গিয়ে বসতি গড়েছিলেন। দুর্গম ও প্রতিকূল আবহাওয়া এর বড় কারণ। যাইহোক, ক্রিমিয়া যুদ্ধে হেরে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেক্সসান্দার বুঝতে পেরেছিলেন, আলাস্কায় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা হয়তো সম্ভব হবে না।
ওই সময়ে আলাস্কার পাশে কানাডায় ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। তাই দ্বিতীয় আলেক্সসান্দার মনে করেছিলেন, যদি ব্রিটেন আলাস্কায় আক্রমণ করে বসে, তাহলে ভূখণ্ডটি রাশিয়ার হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাহলে উপায়? এ পরিস্থিতিতে ১৮৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলাস্কা বিক্রির প্রস্তাব দেয় রাশিয়া।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় গৃহুযুদ্ধ। অবশেষে আমেরিকান গৃহযুদ্ধ শেষ হলে আলাস্কা বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ চুক্তির মধ্য দিয়ে আলাস্কা কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
একই বছরের ৯ এপ্রিল মার্কিন সিনেটে চুক্তিটি অনুমোদন পায়। আর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন ওই বছরের ২৮ মে চুক্তিতে সই করেন। এরপর আর সময় নষ্ট করা হয়নি। একই বছর, অর্থাৎ ১৮৬৭ সালের ১৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাস্কা হস্তান্তর করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আসার পরও দুর্গম ও জনমানবহীন দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল আলাস্কা। প্রায় এক শতাব্দী পর এসে ১৯৫৯ সালের ৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯তম অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা পায় আলাস্কা।
কত দামে আলাস্কাকে বিক্রি করেছিল রাশিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নামমাত্র দামে আলাস্কা বিক্রি করেছিল রাশিয়া। লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের নথি বলছে, রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কায় ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৪১২ বর্গমাইল বা প্রায় ১৫ লাখ ১৮ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার জমি কিনেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য তাদের দিতে হয়েছিল ৭২ লাখ ডলার। সেই হিসাবে, প্রতি একর জমির দাম পড়েছিল মাত্র ২ সেন্ট।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন