ঢাকা শুক্রবার, ০৬ জুন, ২০২৫

জমে উঠছে পশুর হাট 

এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: জুন ৫, ২০২৫, ০১:৫০ এএম
কোরবানীর পশুর হাট। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। মুসলমানদের সর্ববৃহৎ এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঢাকার কোরবানির হাটগুলোতে এখন কেনাবেচার চূড়ান্ত ব্যস্ততা। সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ অফিসে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় সকাল থেকেই পশুর হাটগুলোতে ক্রেতারা ভিড় জমাচ্ছেন। পশুর হাটগুলোতে ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদাই বেশি। তবে সরবরাহ থাকলেও দাম যেমন বেশি, তেমনিভাবে বাড়তি পিকআপ ভাড়া নিয়ে ক্রেতারা পড়ছেন বিপত্তিতে। দাম নিয়ে বিক্রেতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যে কোনো ধরনের অনাকাক্ষিত ঘটনা এড়াতে হাটগুলোতে প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

বুধবার (০৪ জুন) সকালে তুলনামূলক পশুর উপস্থিতি কম থাকলেও দুপুরের পর থেকেই জমে উঠছে হাটগুলো। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই দিনের তুলনায় আজকের (গতকাল) দিনে পশু বিক্রি বেড়েছে। বড় গরুর তুলনায় ছোট গরুর চাহিদা তুঙ্গে। যদিও দাম এখনো কিছুটা বেশি, তবে শেষ মুহূর্তে ক্রেতারা দরদাম করেই গরু নিচ্ছেন। গতকাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর গাবতলী কোরবানির পশুর হাট ঘুরে, হাটসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, নির্ধারিত গেট পেরিয়ে পাশে ইট-বালুর মাঠ ও সড়ক পর্যন্ত ত্রিপল টাঙিয়ে রাখা হয়েছে পশু। ভেতরে ও বাইরে দুই স্থানেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়। গরু বাছাই করছেন ক্রেতারা। কেউ পছন্দ করে কিনে ফেলছেন, কেউ আবার দাম যাচাই করে ফিরে যাচ্ছেন।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে এবার চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পাবনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর ও ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ গরু এসেছে। 

গাবতলী হাটে কর্মরত একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পাঁচ শতাধিক গরু হাটে প্রবেশ করেছে। তবে পশুর আমদানি বেড়েছে বলেই দাম যে কমেছে, এমন নয়। খামারিরা বলছেন, খরচ এত বেড়েছে যে গরুর দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না।

সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও দাম ‘চড়া’

এবার হাটে গরুর সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক হলেও দাম অনেকটাই ‘চড়া’ বলে মন্তব্য করেছেন বেশির ভাগ ক্রেতা। ছোট আকারের গরুর দাম শুরু হচ্ছে ৭০-৮০ হাজার টাকা থেকে। মাঝারি গরু বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে। বড় গরু ৩ লাখ থেকে শুরু করে ৬-৭ লাখ টাকাও হাঁকা হচ্ছে। 

গাবতলী হাটে কথা হয় বাড্ডা থেকে আসা একটি পরিবারের সঙ্গে। তাদের মধ্যে মাসুম হোসেন নামে একজন বলেন, ‘দুইটা মাঝারি গরু দেখেছি। একটা ১ লাখ ৫০, আরেকটা ১ লাখ ৮০ চাইছে। গতবার এই সাইজের গরু ১ লাখ ২০ হাজারের মধ্যে পেয়ে গিয়েছিলাম। দাম একটু বেশি হলেও পশুগুলোর মান ভালো, তাই ভেবে দেখছি।

ক্রেতাদের অভিযোগ, হাট থেকে পশু বাড়ি নেওয়ার খরচ এখন আকাশছোঁয়া। বিশেষ করে পিকআপ ভাড়া অতীতের তুলনায় অনেক বেশি।’

মিরপুরের বাসিন্দা সুমন রহমান বললেন, ‘একটা মাঝারি গরু কিনেছি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। গাবতলী থেকে ডেমরায় নিতে ৫ হাজার টাকা চাইছে। ৩ হাজারে রাজি করিয়েছি। কিন্তু এই খরচটাও অনেক।’ 

পশু পরিবহনে বাড়তি খরচের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা গ্রাম থেকে আসি ট্রাকে। এবার শুধু এক ট্রিপ ট্রাক ভাড়া লেগেছে ৭০ হাজার টাকা। খাবার, হেলপারদের খরচ, ট্রাকভাড়া মিলিয়ে গড়ে প্রতিটি গরুর পেছনে ২০-২৫ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাচ্ছে দাম।’

বিক্রেতারা বলছেন, এবারের কোরবানির হাটে ক্রেতাদের মধ্যে ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে ১০ থেকে ১৮ মনের গরু বেশি বিক্রি হচ্ছে। তাদের দাবি, বর্তমান বাজারে ৬ থেকে ৮ মণের গরু আনুমানিক ২৪০-৩২০ টাকা কেজিতে ৮৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ১০-১২ মণের গরু ৪০০-৪৮০ টাকা কেজিতে আনুমানিক দেড় থেকে ২ লাখের মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ১৫ থেকে ১৮ মণের গরু ৬০০ থেকে ৭২০ টাকা কেজিতে ২ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত কেনাবেচা হচ্ছে। তবে ২০ মণের অধিক গরু ৮০০ টাকা কেজিতে সাড়ে ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখে (কম চাহিদা) বিক্রি হচ্ছে।

দাম নিয়ে বিক্রেতাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

রাজধানীর গাবতলী, শ্যামপুর ও শনির আখড়ার হাটগুলোতে পশুর সরবরাহ থাকলেও দাম ও বিক্রির বিষয়ে দেখা যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের গরু তুলনামূলক ভালো দামে বিক্রি হলেও বড় গরুর ক্রয়-বিক্রয়ে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। 

যশোর থেকে গরু নিয়ে আসা খামারি মো. আনুর আলী বলেন, ‘আমি আটটা ছোট গরু এনেছি। এর মধ্যে ছয়টা বিক্রি হয়ে গেছে। ৮০ থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে বিক্রি করেছি। ছোট গরুর চাহিদা বেশি, কারণ ঢাকায় অনেকে বাসায় রাখার জায়গার অভাবে বড় গরু কিনতে চায় না।’ পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সিরাজগঞ্জের খামারি খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মাঝারি-বড় মিলিয়ে ১০টা গরু এনেছি। এখনো ৭টা পড়ে আছে। দাম চাইলেই ক্রেতারা কেবল দেখে চলে যাচ্ছে। আমার একটার ওজন প্রায় ২০ মণ, দাম বলেছি ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তারা বলছে ১ লাখ ৮০ হাজার; এইভাবে তো বিক্রি করা সম্ভব না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতি বছরই দেখি, ঢাকায় মানুষ গরু কেনে শেষ সময়ে। এখন যারা হাটে আসছেন, তারা শুধু দেখে যাচ্ছেন কিংবা ছোট গরু কিনছেন। বড় গরুর ক্রেতারা এখনো মাঠে নামেননি। আমরা ধরে নিচ্ছি বৃহস্পতিবার (০৫ জুন) বিকেল থেকে কাল শুক্রবার পর্যন্ত মূল ক্রেতারাই হাটে আসবেন। তখন বিক্রিও দ্বিগুণ হবে, দামও কিছুটা বাড়বে।’

নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় উন্নতি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বেশির ভাগ হাটেই সিসিটিভি, মেডিকেল টিম, ভেটেরিনারি সেবা, মাইকিং, মলমূত্র ব্যবস্থাপনায় কিছুটা উন্নতি হলেও বৃষ্টির কারণে হাটের অনেক স্থানে কাদা জমেছে। বিশেষ করে গাবতলী হাটে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়েরই ভোগান্তি হচ্ছে। 

এ বিষয়ে হাটের ইজারাদার তারেক ইসলাম বলেন, হাট ইজারা নিতে ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা গুনেছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্যাট, জামানত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার খরচ। পুরো হাটে ৬০টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে, রয়েছে তিনটি ব্যাংকের বুথ, মেডিকেল টিম, পশুর চিকিৎসক, নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক দল। 

ইজারাদার প্রতিনিধি কে এম ইয়াহিয়া সামি জানান, হাটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী আলাদা ক্যাম্প স্থাপন করেছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও আনসার সদস্যদের জন্য আলাদা জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি জাল টাকা শনাক্তের মেশিন এবং চিকিৎসক দলও রয়েছে। ঈদের বাকি আর মাত্র এক দিন। ঢাকার হাটগুলোতে পশু আমদানি ঠিক থাকলেও দাম ও পরিবহন খরচের কারণে অনেকেই ক্রয় সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছেন। তবে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা, শেষ মুহূর্তে হাট জমবে, বিক্রি বাড়বে এবং এবারের ঈদেও কোরবানির পশুর বাজার শেষ হাসি হাসবে।

প্রসঙ্গত, এবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি মিলিয়ে মোট ২১টি স্থানে পশুর হাট বসানো হয়েছে। প্রতিটি হাটেই বিক্রি হচ্ছে গরু, ছাগল, ভেড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির কোরবানির পশু।