জীবনে প্রিয়জন হারানো এক অপূরণীয় বেদনা। প্রিয়জনের মৃত্যুর শোক আসলেই ভয়াবহ। তা কতটা যন্ত্রণার ও মারাত্মক হতে পারেÑ এটি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন ছেপেছে ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ জার্নাল। গবেষণাটি ১০ বছর ধরে গভীর শোক এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র স্থাপন করেছে। পোস্টডক্টরাল গবেষক মেট কেয়ারগার্ড নিয়েলসেনের নেতৃত্বে ডেনমার্কের আরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ১ হাজার ৭৩৫ শোকাহত আত্মীয়ের স্বাস্থ্যগত ফল পর্যালোচনা করেছেন। তারা অংশগ্রহণকারীদের ‘নি¤œ’ এবং ‘উচ্চ’ স্তরের শোকের লক্ষণ অনুভবকারী দলে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন। দশকব্যাপী এই গবেষণায় একটি স্পষ্ট পার্থক্য দেখা গেছে, উচ্চ শোকের লক্ষণযুক্তদের মধ্যে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ মারা গেছেন, যেখানে কম শক্তিশালীভাবে প্রভাবিত ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক ৩ শতাংশ মারা গেছেন। ‘উচ্চ স্তরের’ শোকে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ৯টি চিহ্নিত লক্ষণের অর্ধেকেরও বেশি অনুভব করে। যার মধ্যে রয়েছে মানসিক অসাড়তা, অর্থহীনতার অনুভূতি, ক্ষতি মেনে নিতে অসুবিধা এবং নিজের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি। গবেষণায় উচ্চ শোকের লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সঙ্গে বর্ধিত মিথস্ক্রিয়া লক্ষ করা গেছে, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং প্রাথমিক যতেœর উচ্চ ব্যবহার লক্ষ করা গেছে। শোকের কারণে দীর্ঘস্থায়ী এই চাপ রক্তচাপ বৃদ্ধি, কর্টিসলের মাত্রা বৃদ্ধি, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ হতে পারে। সুপ্রতিষ্ঠিত ‘ব্রোকেন হার্ট সিন্ড্রোম’Ñ যাকে স্ট্রেস-প্ররোচিত কার্ডিওমায়োপ্যাথি বা টাকোটসুবো কার্ডিওমায়োপ্যাথিও বলা হয়, এটি হৃৎপি-ের পেশির হঠাৎ দুর্বলতা, তীব্র চাপের শারীরিক ক্ষতির একটি প্রধান উদাহরণ। গবেষক মেট কেজারগার্ড নিলসেন সিএনএনকে বলেন, ‘যাদের শোকের প্রবণতা বেশি তারা মৃত্যুর আগে থেকেই দুর্বল আত্মীয়দের একটি দল বলে মনে হয়, যাদের বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘(তাদের) অতিরিক্ত সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। তারা কষ্ট অনুভব করতে পারেন এবং পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে অসুবিধা হতে পারে।’ যদিও এই গবেষণায় মৃত্যুর কারণগুলো নির্দিষ্ট করা হয়নি, তবে এর ফলাফলগুলো কীভাবে আঘাতমূলক ক্ষতি শারীরিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত কওে, সে সম্পর্কে বিদ্যমান গবেষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের কার্ডিয়াক ফার্মাকোলজির অধ্যাপক ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সিয়ান হার্ডিং গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ‘অনুদৈর্ঘ্য দৃষ্টিভঙ্গি’ তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘হৃদরোগের ওপর শোকের তীব্র প্রভাব সুপরিচিত হলেও, এই গবেষণাটি দীর্ঘস্থায়ী, ক্ষতিকারক প্রভাব প্রদর্শন করে, যা হৃদরোগ এবং অন্যান্য অসুস্থতার আকারে প্রকাশ পেতে পারে।’ হার্ডিং আরও বলেন, ‘এটা আমার কাছে বিশেষভাবে অবাক করার মতো বিষয় নয় যে এই বিশেষ ধরনের চাপ দীর্ঘস্থায়ী হলেও, শরীরের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। এটি বিশেষ করে হৃদরোগ হিসেবে বেরিয়ে আসতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে।’ গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবার বা কাছের কারো মৃত্যু, যেমনÑ স্বামী, স্ত্রী, ভাই, বোন, সন্তান কিংবা বন্ধুর অকালমৃত্যুতে মানুষ ভীষণভাবে মানসিক আঘাত পেয়ে থাকেন। এ ধরনের মানসিক আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের মাঝে মানসিক পীড়া ১৬ সপ্তাহ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত, অথবা আরও বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে। এ ধরনের মানসিক সমস্যা থেকে তীব্র বিষণ্ণতার সৃষ্টি হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রিয়জনের অকালমৃত্যুতে অনেকের মাঝেই এমন ধারণা তৈরি হয় যে; মৃত্যুর পরও প্রিয়জন তাদের সঙ্গেই আছেন বা তাকে দেখতে পাচ্ছেন এমন ভ্রম তৈরি হয়। খুব কাছের কারো মৃত্যু অকালমৃত্যু মেনে নেওয়া সত্যিই খুব কঠিন। এমন মৃত্যুতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন পরিবার, স্বজন ও বন্ধুরা। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, খুব কাছের কারো মৃত্যুতে একাকিত্ব, বিষণœতাসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :