সালমান শাহ গত হয়েছে ঊনত্রিশ বছর। প্রায় আড়াই যুগ। সময়টা কম নয়! বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো চুয়ান্ন বছর। ৫৪ বছরের সালমান দেখতে কেমন হতো। তার ক্যারিয়ার এবং বাংলাদেশের সিনেমা আজ কোথায় এসে দাঁড়াত। এসব অবশ্য কল্পনা করা মুশকিল। বাস্তবতা, আমাদের স্মৃতিতে একজন আত্মবিশ^াসী, সুর্দশন তরুণ যুবক রূপে বেঁচে আছে সালমান শাহ। এবং থাকবে। আজও সে অসংখ্য জনের স্বপ্নের নায়ক।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহের মৃত্যুর পর ‘সালমান ভক্ত’ নামে একটি সোসাইটি গড়ে ওঠে। এমন ভক্তকুল পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। প্রিয় নায়কের মৃত্যুশোক তাৎক্ষণিক সইতে না পেরে এদের অনেকে পৃথিবী ছেড়েছে। কিন্তু এমনটা তো হবার কথা ছিল না। একজন দিব্যি সুস্থ, প্রাণচঞ্চল তরুণ দিন-রাত সিনেমার কাজে ব্যস্ত। প্রযোজক, পরিচালক যার সিডিউল নিতে এফডিসি কিংবা তার বাসায় একরকম ধরনা দিতেন। সেই মানুষটা কিনা কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই থেমে গেল! এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত!
নব্বইয়ের দশকে ঢাকাই সিনেমার সোনালি দিনের সব থেকে উজ্জ্বল পালক ছিল সালমান শাহ। একের পর এক সুপারহিট সিনেমা। ঈদ-পূজা উপলক্ষে যার সিনেমা মানে হলের টিকিট কাউন্টারে অগুন্তি মানুষের উপচেপড়া ভিড়। টিকিট ব্ল্যাকিং। কখনো কখনো টিকিট না পেয়ে কাউন্টার ভাঙচুর! এসব ছিল আমাদের প্রত্যক্ষ। বিশেষ করে, সেই সময়ে সামাজিক বাস্তবতায় হলে গিয়ে সিনেমা দেখা ছিল প্রশান্তির ব্যাপার। আর সেই প্রশান্তির নাম ছিল সালমান শাহ। যে কারণে তার আকস্মিক মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারেনি। তার ডাই হার্ট ফ্যানরা কেউ কেউ তো মরে গিয়ে প্রমাণ করেছে- যে পৃথিবীতে সালমান নেই সেই পৃথিবী মিথ্যা! এমন নজির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে বলে জানা নেই!
ঊনত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া তার মৃত্যুর পর আজ পর্যন্ত দুটো প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। সালমানকে কি হত্যা করা হয়েছে নাকি সে আত্মহত্যা করেছে। ঘটনার পরম্পরায় আমরা জানি। প্রথমে তার স্ত্রী এবং তার শ^শুরালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু তার বাবা-মার কাছে বিষয়টা বিশ^াসযোগ্য মনে হয়নি। সালমানের বাবা পাশর্^বর্তী রমনা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করে। এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে। যে কারণে মৃত্যুর এক বছরের মাথায় অপমৃত্যুর মামলা হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করে। আদালত তখন সিইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্ত চলাকালীন সময়ে ১৯৯৮ সালে সালমন শাহের বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। এরপর মা নীলা চৌধুরী মামলা চালিয়ে নেয়। দীর্ঘ তদন্তের পর সিআইডি প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে সালমন শাহ আত্মহত্যা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। সেই প্রতিবেদন সালমানের মা না রাজি সম্মতি জানান। এরপর র্যাব এবং সবশেষ পিবিআই-এর তদন্ত প্রতিবেদনে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে উল্লেখ করা হয়। প্রত্যকবার মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যায় নীলা চৌধুরী না রাজি সম্মতি জানিয়েছে। এসবের মধ্যে ২০১৭ সালে আমেরিকা থেকে রুবি নাম একজন ফেসবুক লাইভে এসে বলে বসেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করে নাই তাকে খুন করা হয়েছে। এই খুনের সঙ্গে তার স্ত্রী এবং শ^শুরবাড়ির লোক জড়িত। রুবি নিজেও সালমান হত্যা মামলার আসামি। তার ওই ফেসবুক লাইভ মুহূর্তে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
উল্লেখ, বিগত এসব ঘটনা সালমান ভক্তদের কাছে বইয়ের পাতার মতো মুখস্থ! তারপরও ২০২৫ সালে এসেও দেখা যায় সালমান শাহের জনপ্রিয়তা এবং তার প্রতি ভক্তকুলের তীব্র আকাক্সক্ষায় একটুও মরিচা ধরেনি। বিশেষ করে, গত ২০ অক্টোবর মহানগর দায়রা জজ আদালত যেদিন আদেশ দেয় সালমান শাহের অপমৃত্যু হত্যা মামলায় রূপান্তরে। মুর্হূতে দেশজুরে আবারও শুরু হয় সালমান সুনামি। ভাবটা এমন যে এবার আমরা সত্য উদ্ঘাটনের খুব কাছে!
সালমান শাহকে খুন করা হয়েছে! এমন দৃঢ় বিশ^াস অসংখ্য জনের। সেই থেকে আজ অবধি সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে একটাই ট্রপিক সালমান শাহের খুনের মামলা! অনেকে তো পারলে নিজেই রায় লিখে ফেলেন! কিন্তু আবেগ অনুরাগ কিংবা রিরাগ দিয়ে তো আর আইনের গতি নির্ধারিত হয় না। আইন চলে সঠিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে। তবে বাংলাদেশের মানুষ সালমান শাহের মৃত্যুর বিষয়ে একটা সুরহা দেখতে চায়। এবং সেটা সঠিক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের উপর ভর করে। যেখানে সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরীর না রাজি সম্মতি দেওয়ার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাবে না। সালমান ভক্তরা একরকম দায়ভার থেকে মুক্তি পাবে। দায়ভার কেন! কারণ, খুব কম সময়ের মধ্যে সালমান শাহ যে মায়াজাল এবং স্বপ্নের ঠিকানা তার দর্শকদের জন্য রচনা করে গেছে তা অপূরণীয়। সালমান পরবর্তী তার ভক্তদের আকাক্সক্ষা সেভাবে কেউ পূরণ করতে পারেনি। সুতরাং তার প্রতি দায়ভার তো থাকবেই। আসলে সালমান ছিল ক্ষণজন্মা একটি নক্ষত্র। যার আলোর দ্যুতি দীর্ঘ সময় নেওয়ার মতো ক্ষমতা হয়তো আমাদের ছিল না। যে কারণে কিছু না বলে হঠাৎ করে চলে গেলেন কৃষ্ণগহব্বরের অন্তহীন গন্তব্যে।
সবশেষ আদালত সালমান শাহ হত্যা মালার ১১ জন আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি কারেছে। এদের মধ্যে প্রথম চারজন সবার পরিচিত। সালমানের প্রাক্তন স্ত্রী সামির হক, শাশুড়ি লতিফা হক লুসি, খলনায়ক ডন এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই যে কিনা চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পালাতক আসামি। বাকিদের মধ্যে অনেকেই দেশে নেই। এখন কথা হলো এবার কি সালমান শাহের মৃত্যুর প্রকৃত সত্য জানা যাবে নাকি সেই পূর্বের মতো অন্ধকারে আমাদের চোখ বেঁধে দেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন