রাশিয়ার রাজধানী মস্কো শহর থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পূর্বে, ভলগা এবং ওকা নদীর মিলনস্থলে দাঁড়িয়ে আছে এক চিরঐতিহ্যের শহর- নিজনি নভোগরদ। শহরটিতে একদিকে যেমন রয়েছে রাশিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তেমনি রয়েছে সামরিক ইতিহাস। সবমিলিয়ে রাশিয়ার ষষ্ঠ বৃহৎ এই নগরী পুরো রাশিয়ারই যেন এক অনন্য প্রতীক। গত সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে এই শহরটিতেই আয়োজিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল অ্যাসেম্বলি ২০২৫’, যেখানে রাশিয়ার এক হাজার এবং বিশ্বের অন্যান্য ১২০টি দেশ থেকে আরও এক হাজার তরুণ প্রতিনিধি অংশ নেন। বিশ্বের প্রায় ৩০ জন সাংবাদিকের সঙ্গে এই আয়োজনে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম আমি নিজেও। শহরটিতে ছয় দিন অবস্থানের অভিজ্ঞতা থেকে নিজনি নভোগরদের নানান দিক থাকছে এই লেখায়। নিজনি নভোগরদ শহরের নানান পর্যটক আকর্ষণকেন্দ্র ভ্রমণ এবং সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে আমাদেরকে সহযোগিতা করে ‘রসমোলোদেজ’ নামক একটি সরকারি সংস্থা। ‘মোর দ্যান এ ট্রিপ’ শীর্ষক এক প্রকল্পের
মাধ্যমে দেশটির ৩৭০টি ট্যুর অপারেটরের সহযোগিতায় তরুণদের জন্য বিভিন্ন ভ্রমণের আয়োজন করে সংস্থাটি।
নামকরণ
‘নিজনি’ শব্দের অর্থ ‘নি¤œভাগ’ এবং নভোগরদ শব্দের অর্থ ‘নতুন শহর’। সেন্ট্রাল রাশিয়া থেকে দক্ষিণে বহমান তিন হাজার ৫৩১ কিলোমিটার (কিমি) দৈর্ঘ্যরে ভলগা ইউরোপের সর্ববৃহৎ নদী। কাগজের মানচিত্রে দেখলে, এই নদীর নিচের অংশেই শহরটির অবস্থান। ভলগা নদীর পাদদেশে নতুন এই শহরটির গোড়াপত্তন হওয়ায় এর নাম হয় ‘নিজনি নভোগরদ’। এই শহরেই কোলেই ভলগা মিলিত হয় ওকা নদীর সঙ্গে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় ১৯৩২ সালে সমাজতান্ত্রিক বলয়ের প্রভাবে, রুশ সাহিত্যিক ম্যাকসিম গোর্কির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহরটির নাম বদলে রাখা হয় ‘গোর্কি’। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর ১৯৯০ সালে পুরোনো নাম ফিরে পায় শহরটি।
১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিদেশিদের প্রবেশাধিকার ছিল না
ঐতিহ্য, সৌন্দর্য আর ইতিহাসে সমৃদ্ধ এই শহরটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিদেশি নাগরিকদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার বিভিন্ন সামরিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ, যানবাহন এবং অন্যান্য সামরিক সম্পদ মজুত ছিল নিজনি নভোগরদে। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক গবেষণা এবং কৌশলগত নীতিনির্ধারণ প্রণয়নে এই শহরেই জমায়েত হতেন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা। বলা হতো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়াকে হারাতে হলে, নিজনি নভোগরদ বিজয় করতে হতো জার্মানিকে। সেই থেকেই শহরটি বিদেশিদের জন্য পুরোপুরি বন্ধ ছিল। অবশেষে ১৯৯১ সালে বিদেশি নাগরিকদের জন্য খুলে দেওয়া হয় নিজনি নভোগরদের প্রবেশদ্বার। এরপর স্বল্প সময়েই পরিণত হয় রাশিয়ার এক প্রাণবন্ত বাণিজ্যিক ও পর্যটনকেন্দ্রে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শহরটি পর্যটকদের ব্যাপক আকর্ষণ পায় ২০১৮ ফুটবল বিশ্বকাপে। সে বছর ফিফা ওয়ার্ল্ড ২০১৮ এর আয়োজক দেশ ছিল রাশিয়া, আর নিজনি নভোগরদ স্টেডিয়ামে সেই আসরের ছয়টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এসব ম্যাচে অংশগ্রহণকারী দেশের মাঝে ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি আর্জেন্টিনাও ছিল। ফলে শহরটির নাম দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ফুটবল ও পর্যটকপ্রেমীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
ভলগা ও ওকার মিলনে অনিন্দ্য দৃশ্য
নিজনি নভোগরদের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় ভলগা ও ওকা নদীর সংযোগস্থলে। আমাদের যখন এই দুই নদীর সংযোগস্থল পরিদর্শনে নেওয়া হলো তখন আমাদের পলক ফেলানোর সুযোগ ছিল না। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা বা নৌবিহারে ভেসে বেড়ানো, প্রতিটি মুহূর্তই যেন সময়কে থামিয়ে দেয়। তবে ভলগা নদীজুড়ে ছিল এক প্রাণচঞ্চল পরিবেশ। নদীর তীরে দেখা মিলল বিশাল সব বাণিজ্যিক জাহাজের, যেগুলো আশপাশের এলাকা থেকে কাঠ, কৃষিপণ্য এবং নানা ধরনের মালপত্র শহরে নিয়ে আসছে। ফেরি, ইয়ট ও ছোট ছোট নৌকাও পানির বুকে ছুটে চলেছে, পর্যটক ও স্থানীয় মানুষদের এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে পৌঁছে দিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছিল, রাশিয়া পরিবহনের জন্য এই নদীকে ব্যবহারে বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে। দুই নদীর সংযোগস্থল হওয়ার সুবিধায় নিজনি নভোগরদ ঐতিহাসিকভাবে এক সফল বাণিজ্যিক শহর।
নদীর ধারে ছিল সারি সারি বিলাসবহুল গাড়ি। অনেক নবদম্পতি এখানে এসে বিয়ের ফটোসেশন করেন এবং এই গাড়িগুলো ভাড়া নিয়ে বিয়ের দিনের বিশেষ সফরে বের হন। নদীর তীরজুড়ে শোভা পাচ্ছিল নান্দনিক শিল্পকর্ম, যা পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। অনেকে থেমে গিয়ে সেগুলোর সঙ্গে ছবি তোলে, উপভোগ করে নদীতীরের সেই শিল্পময় সৌন্দর্য। খাবারের জন্য আশপাশেই রয়েছে বিভিন্ন ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ।
ক্রেমলিন- শহরের হৃদয়
রাশিয়ার ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, শহরের প্রধানতম দুর্গ বা রাজার বাসস্থানকে ‘ক্রেমলিন’ বলা হয়ে থাকে। এগুলো সাধারণত লাল রঙের দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে। মস্কো শহরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের দাপ্তরিক বাসভবনের নামও ক্রেমলিন। তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী ক্রেমলিন রয়েছে নিজনি নভোগরদেও। ভলগা এবং ওকা নদীর সংযোগস্থলের তীরেই রয়েছে নিজনি নভোগরদ শহরের ক্রেমলিন। ষোড়শ শতকে নির্মিত এই দুর্গ আজও শহরের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রাচীরঘেরা এই এলাকাই এখন প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রাণকেন্দ্র। ক্রেমলিনের টাওয়ারে উঠে দেখা যায় দুই নদীর মিলন আর শহরের মনোরম দৃশ্য, যা একবার দেখলে ভোলা কঠিন।
সংস্কৃতি ও জীবনধারা
নিজনি নভোগরদ শুধু ইতিহাস নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক নগরীও বটে। থিয়েটার, আর্ট গ্যালারি, সংগীত উৎসব আর ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের বাজারÑ সব মিলিয়ে শহরটি যেন শিল্পের এক মুক্ত মঞ্চ। বিশেষ করে ‘বোলশায়া পোকরোভস্কায়া স্ট্রিট’ হলো শহরের প্রাণ, যেখানে রঙিন ক্যাফে, পথশিল্পী ও পুরোনো স্থাপনার মিলনে তৈরি হয় এক প্রাণবন্ত পরিবেশ।
বাণিজ্যেরও কেন্দ্রবিন্দু
ভলগা নদীর তীরঘেঁষে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজনি নভোগরদ বাণিজ্যিক শহর হিসেবে বিকশিত হয়েছে। বর্তমানে এটি রাশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র, যেখানে রয়েছে প্রযুক্তি পার্ক, আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী কেন্দ্র এবং
বহু বহুজাতিক কোম্পানির কার্যালয়। বিভিন্ন বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ও আছে এখানে। তাই অনেকে শহরটিকে রাশিয়ার ‘আইটি টাউন’ বলে থাকে।
রাতের রূপ
রাতের নিজনি নভোগরদ একেবারেই অন্যরকম। আলো ঝলমলে সেতু, নদীর জলে প্রতিফলিত শহরের আলোকরেখা, আর ঠান্ডা বাতাসে মিশে থাকা সংগীতের ছন্দÑ সব মিলিয়ে মনে হয়, আপনি যেন কোনো ইউরোপীয় রূপকথার শহরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এখানকার সেন্ট্রাল শপিং মল রাত ২টা পর্যন্ত চালু থাকে। শপিং মলের ফুডকোর্টসহ বেশকিছু রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, পাব ও ক্লাব রয়েছে যারা নিজনির নাইট লাইফকে উপভোগ্য করে।
ভ্রমণ টিপস
যাবার উপায় : মস্কো থেকে ট্রেনে বা বাসে সহজেই যাওয়া যায়। ট্রেনের প্রকারভেদ অনুযায়ী, ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ভাড়া পড়তে পারে সর্বনি¤œ ৪৫ মার্কিন ডলারের মতো। আর উড়োজাহাজে গেলে মস্কো থেকে নিজনি নভোগরদ ১ ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। হাতে যত সময় রেখে টিকিট কাটা যায়, দাম ততো কম পড়বে।
থাকার জায়গা : নিজনি নভোগরদ শহরে আরামদায়ক অবস্থানের জন্য এক তারকা থেকে পাঁচ তারকা পর্যন্ত হোটেল আছে। বিশ্বের বৃহৎ হোটেল চেইনগুলোর প্রপার্টি আছে এখানে। চাইলে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের হোটেল থেকেও রুম ভাড়া করে থাকতে পারেন। সময়কাল ভেদে এগুলোর ভাড়া কমবেশি হয়। এখানকার হোটেলের রুমগুলো সাধারণত স্বয়ংসম্পূর্ণ বাসার মতো হয়ে থাকে। একটি পরিবারের থাকার জন্য যা যা লাগে, তারই সবই থাকে রুমগুলোতে। এমনকি অতিথি চাইলে রুমে থাকা ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করে রান্না করে রুমেই খেতে পারেন। সকল ডাইনিং ইকুইপমেন্ট রুমে দেওয়া থাকে।
খাবার : রুশ ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রেস্টুরেন্টও আছে পর্যাপ্ত। চাইলে খুব সহজেই পাওয়া যায় হালাল খাবার। প্রতিবেলা একজনের এখানে খাওয়া খরচ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫০০-৭০০ টাকা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ‘সেভেন ইলেভেন’ এর মতো এখানে কিছু ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। সেগুলোতে তুলনামূলক অনেক স্বস্তায় প্রি-মেড ফ্রোজেন ফুডসহ বিভিন্ন ধরনের স্ন্যাকস খাবার পাওয়া যায়।
তবে পানির দাম বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। তাই সঙ্গে একটি বোতল বা ফ্লাস্ক রাখা ভালো। বিভিন্ন স্থাপনায় বিনা মূল্যে পানি রিফিলের সুযোগ আছে।
ভ্রমণের সেরা সময় : বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর শহরটির আবহাওয়া সবচেয়ে আরামদায়ক থাকে। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে বৃষ্টি কমে আসে, রাতে দিনের তুলনায় ঠান্ডা বেশি অনুভূত হয়। নভেম্বর থেকে তুষার পড়া শুরু হয়ে যায়।
মুদ্রা : রাশিয়া ভ্রমণের সময় দেশটির নিজস্ব মুদ্রা রুবল সঙ্গে রাখা সর্বোত্তম। এখানে বিদেশি কোন ধরনের ক্রেডিট কার্ডই কাজ করে না। বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার থেকে রুবল করার সুযোগ আছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন