বাংলাদেশের নারীরা আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রসর হচ্ছে, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা সৃষ্টি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বেও তাদের পদচারণা দৃশ্যমান। কিন্তু এই অগ্রযাত্রার পথে এক অদৃশ্য দেয়ালের মতো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে অনিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা। অফিসগামী নারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কিংবা শ্রমজীবী নারীÑ প্রায় সবাইকে প্রতিদিন এই অনিরাপদ যাত্রার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একদিকে যানজট ও ভোগান্তি, অন্যদিকে মানসিক ও শারীরিক হয়রানির আশঙ্কাÑ সব মিলিয়ে গণপরিবহন নারীর কাছে হয়ে উঠেছে এক প্রকার ভয়াবহ বাস্তবতা। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন যদি সবার জন্য হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই আধা জনগোষ্ঠীর নিরাপদ চলাচল এখনো কেন অনিশ্চিত? কবে নাগাদ দেশের গণপরিবহন সত্যিকার অর্থে নারীবান্ধব হবে?
প্রতিদিন সকালে যখন একজন নারী কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হন, তখন তার যাত্রাপথের প্রধান সঙ্গী হয় একরাশ উদ্বেগ। গন্তব্যে পৌঁছানোর এই দৈনন্দিন সংগ্রাম শুধু যানজট বা বাসের অপ্রতুলতার বিরুদ্ধে নয়, এই সংগ্রাম নিজের আত্মমর্যাদা এবং নিরাপত্তা টিকিয়ে রাখার। প্রশ্নটি তাই খুব সহজ এবং একই সঙ্গে খুব জটিল: বাংলাদেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা কবে সত্যিকার অর্থে নারীবান্ধব হয়ে উঠবে?
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের অভূতপূর্ব সাফল্য আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু এই অগ্রযাত্রার পথে এক বিশাল প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গণপরিবহনের অনিরাপদ এবং নারীবিদ্বেষী পরিবেশ।
বাস্তবতা হলো, বাসে ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত একজন নারীকে প্রতিটি মুহূর্তে যুদ্ধ করতে হয়। বাসের ভিড়ে অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শ, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, বাসের চালক ও সহকারীর অবহেলা এবং অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি যৌন হয়রানির শিকার হওয়া এদেশের নারীদের জন্য এক নিত্যনৈমিত্তিক, তিক্ত অভিজ্ঞতা। ‘মহিলা সিট’ নামক যে কয়টি আসন বরাদ্দ থাকে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং সেই আসনগুলোও প্রায়শই পুরুষ যাত্রীদের দখলেই থাকে। প্রতিবাদ করলে মেলে কটূক্তি, অথবা হতে হয় নীরব দর্শক।
সন্ধ্যার পর এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বাস স্টপেজের অপর্যাপ্ত আলো, অনিরাপদ পরিবেশ এবং বাসের সংখ্যা কমে যাওয়াÑ সব মিলিয়ে নারীর চলাচলকে সীমিত করে ফেলে। এই ভয়ের সংস্কৃতি কেবল নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতাই খর্ব করে না, তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকেও গলাটিপে হত্যা করে। অনেক নারী শুধু নিরাপদ গণপরিবহনের অভাবেই কাক্সিক্ষত চাকরি বা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
কেন এই ব্যর্থতা?
গণপরিবহনকে নারীবান্ধব করার আলোচনা নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে ‘মহিলা বাস’ চালু করা বা অ্যাপ-ভিত্তিক বিশেষ সেবা চালুর মতো কিছু বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যার গভীরে যাওয়া হয়নি।
প্রথমত, মানসিকতার পরিবর্তন। পরিবহন খাতের শ্রমিক, চালক, সহকারী থেকে শুরু করে সাধারণ পুরুষ যাত্রীÑ অনেকের মধ্যেই নারীকে একজন সহযাত্রী হিসেবে সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতা তৈরি হয়নি। নারীকে ‘বস্তু’ বা ‘দুর্বল’ ভাবার এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই হয়রানির মূল উৎস।
দ্বিতীয়ত, আইনের শাসনের অভাব। হয়রানির শিকার হলেও সামাজিক লোকলজ্জা, প্রমাণ দাখিলের জটিলতা এবং আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ভয়ে অধিকাংশ নারীই চুপ করে থাকেন। যে গুটিকয়েক ঘটনা সামনে আসে, সেখানেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ বিরল। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায় এবং নতুন করে অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়।
তৃতীয়ত, অবকাঠামোগত দুর্বলতা। আমাদের বাস টার্মিনাল, বাসের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ, বা স্টপেজগুলো নারীর বিশেষ চাহিদা (যেমন শিশুসহ ভ্রমণ, নিরাপত্তা) মাথায় রেখে ডিজাইন করা হয়নি। সিসিটিভি ক্যামেরার অভাব, বাসে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেমের অকার্যকারিতা এবং হয়রানি রিপোর্ট করার সহজ কোনো ব্যবস্থার অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
সমাধানের সন্ধানে: শুধু তারিখ নয়, চাই অঙ্গীকার
প্রশ্ন ছিল, ‘কবে’ গণপরিবহন নারীবান্ধব হবে? এর উত্তর কোনো নির্দিষ্ট তারিখে নয়, এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের সম্মিলিত সদিচ্ছা এবং কার্যকর পদক্ষেপে।
জিরো টলারেন্স নীতি ও কঠোর আইন প্রয়োগ : গণপরিবহনে যেকোনো ধরনের হয়রানির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হয়রানির অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। প্রতিটি বাসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং তা সচল আছে কিনা তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
পরিবহন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ : চালক ও সহকারীদের জন্য বাধ্যতামূলক জেন্ডার সংবেদনশীলতা এবং পেশাদার আচরণবিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে, নারী যাত্রীরা তাদের প্রতিপক্ষ নন, বরং সম্মানিত যাত্রী।
অবকাঠামোগত পরিবর্তন : সব বাস স্টপেজে পর্যাপ্ত আলো ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, নারীদের জন্য আলাদা ও পরিচ্ছন্ন টয়লেটের ব্যবস্থা করা এবং বাসের ভেতরে ‘প্যানিক বাটন’ বা সরাসরি পুলিশে অভিযোগ জানানোর হটলাইন নম্বর দৃশ্যমান রাখা প্রয়োজন।
প্রযুক্তিগত সমাধান : ডিজিটাল টিকেটিং ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হলে কন্ডাক্টরদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে বচসা বা অপ্রয়োজনীয় স্পর্শের সুযোগ কমবে। জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাস কখন কোথায় আছে তা জানার সুবিধা নারীর নিরাপত্তাবোধ বাড়াতে পারে।
সামাজিক সচেতনতা : গণপরিবহন যে সবার জন্য, এই বোধ তৈরি করতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। পুরুষদের এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় সহযোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একটি দেশের সভ্যতা পরিমাপের অন্যতম মানদ- হলো সেই দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বা ‘উন্নত বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন আমরা দেখছি, কিন্তু সেই স্বপ্নের পথে অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে রেখে এগোনো সম্ভব নয়। নারীর নিরাপদ চলাচল কোনো বিলাসিতা নয়, এটি তার মৌলিক অধিকার।
গণপরিবহন নারীবান্ধব হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় হয়তো আমাদের জানা নেই। কিন্তু যেদিন একজন নারী মধ্যরাতেও একা বাসে চড়ে নিরাপদে বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা পাবেন, যেদিন বাসের ভিড়ে কোনো অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শের ভয়ে তাকে সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে না, সেদিনই হবে বাংলাদেশের প্রকৃত বিজয়ের দিন। সেই দিনটি আনতে হলে সরকার, পরিবহন মালিক, শ্রমিক এবং সাধারণ নাগরিকÑ সবাইকে আজ থেকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
গণপরিবহন নারীবান্ধব করা কোনো অতিরিক্ত সৌজন্য নয়, এটি ন্যায্য অধিকার এবং টেকসই উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত। কাগজে-কলমে নীতি ও স্লোগান দিয়ে পরিবর্তন আনা যাবে না, প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপÑ কঠোর আইন প্রয়োগ, প্রযুক্তির ব্যবহার, অবকাঠামোগত সংস্কার এবং সর্বোপরি সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তন। আজই সময় এসেছে সমাজের প্রতিটি স্তরে এ প্রতিশ্রুতি জোরালোভাবে উচ্চারণ করারÑ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থাকবে।
যেদিন একজন নারী বিনা ভয়ে, নির্ভয়ে, সম্মান নিয়ে গণপরিবহনে চড়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন, সেদিনই আমরা সত্যিকার অর্থে ‘অগ্রসর বাংলাদেশ’ বলতে পারব। সেই দিনটি যেন দূরে না থাকে এই দায়িত্ব আমাদের সবার।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন