শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৫, ০২:২৩ এএম

স্বাস্থ্যসেবায় টেস্ট-সন্ত্রাস

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৫, ০২:২৩ এএম

স্বাস্থ্যসেবায় টেস্ট-সন্ত্রাস

  • বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় একই পরীক্ষার ভিন্ন ভিন্ন দাম
  • নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে রোগীদের ভোগান্তি
  • একই পরীক্ষা আট হাজার টাকাতেও হয় কোথাও, কোথাওবা ১৮ হাজারে
  • টেস্ট ভেদে সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসকারিতে খরচ বেশি কয়েকগুণ
  • ‘ফি নির্ধারণ ও মান নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা’ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয় না
  • মূল্য বৈষম্যের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত রোগীরা
  • বেসরকারি হাসপাতালে টেস্টের মূল্য নির্ধারণে নীতিমালা তৈরির ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি
  • মেশিনের দাম, ব্যবস্থাপনা খরচসহ প্রতিষ্ঠান ভেদে দাম বাড়ে, বলছেন বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসক এবং রোগীর আনুপাতিক হারের ব্যবধান আকাশপাতাল। সেবা নিয়েও অসন্তোষের কমতি নেই। ফলে বাধ্য হয়েই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ছোটেন রোগীরা। এ কারণে পকেট থেকে বেরিয়ে যায় বড় অঙ্কের টাকা। বিশেষ করে বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ একেক হাসপাতালে একেক রকমের হওয়ায় দ্বিধায় পড়েন রোগীরা। কোনটা বিশ্বাস করবেন আর কোনটা করবেন না তা নিয়ে দেখা দেয় সংশয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর স্বাস্থ্য চিকিৎসায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে। একই পরীক্ষা একেক প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন দামে হওয়ায় রোগীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি, পাশাপাশি বাড়তি ব্যয়ের বোঝা তো রয়েছেই।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে সাধারণ আল্ট্রাসনোগ্রাফি সব ক্ষেত্রেই মূল্য বৈষম্য চরম। একই ধরনের মেশিন, একই দক্ষতার টেকনোলজিস্ট ব্যবহৃত হলেও একেক প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা বাবদ রোগীদের গুনতে হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের টাকা।

একই পরীক্ষা, মূল্যে তফাত আকাশ-পাতাল: সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর শান্তিনগরের পপুলার হাসপাতালে এমআরআই (ব্রেন) পরীক্ষা করাতে খরচ হয় সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা। একই পরীক্ষা স্কয়ার হাসপাতাল, শমরিতা বা ইউনাইটেডের মতো হাসপাতালগুলোয় করাতে রোগীকে গুনতে হয় ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। সিটি স্ক্যানের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মগবাজারের ইনসাফ বারকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে যেখানে সিটি স্ক্যানের পরীক্ষায় নেওয়া হয় সাড়ে চার হাজার টাকা, সেখানে ল্যাবএইড বা সেন্ট্রাল হাসপাতালে এ পরীক্ষার খরচ পড়ে ১২ হাজার টাকার মতো। এ ছাড়াও রক্তের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা (সিবিসি) কোথাও ৩৫০ টাকা আবার কোথাও ৭০০ টাকা। একই রকমভাবে আল্ট্রাসনোগ্রাফির দাম রাজধানীর পদ্মা জেনারেল হাসপাতালে ৭০০ টাকা হলেও স্কয়ার বা বিআরবি হাসপাতালে এক হাজার ৮শ টাকা।

এ ছাড়াও এসজিপিটি টেস্টের ফি সরকারি হাসপাতাল বা সরকারি ল্যাবে ২০০-৩৫০ টাকা। এই টেস্ট করাতে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যয় করতে হয় ৫০০-৮০০ টাকা এবং কিছু বড় হাসপাতালে খরচ পড়ে ৯০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত। ক্রিয়েটিনিন টেস্টের ফি সরকারি হাসপাতাল/সরকারি ল্যাবে নেওয়া হয় ২০০-৩০০ টাকা। সেখানে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এর খরচ পড়ে ৪০০-৭০০ টাকা। কিছু নাম-করা হাসপাতালে নেওয়া হয় সর্বোচ্চ ৮০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত। এইচবিএওয়ানসি (ডায়াবেটিসের ৩ মাসের গড় সুগার) টেস্টের ফি সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয় ৪০০-৬০০ টাকা। যার তুলনায় বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খরচ পড়ে ৮০০-১২০০ টাকা। দেশের কিছু নাম-করা হাসপাতালে যার খরচ ১৩০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত। টিএসএইচ বা থাইরয়েড টেস্ট করাতে সরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবে খরচ হয় ৩০০-৫০০ টাকা, যা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সাধারণত ৭০০-১২০০ টাকা এবং কিছু বড় ও নাম-করা হাসপাতালে ১৩০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।

লিপিড প্রোফাইল বা কোলেস্টেরল টেস্টের ফি সরকারি হাসপাতাল-ল্যাবে প্রায় ৪০০-৬০০ টাকা, যা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সাধারণত ৯০০-১৫০০ টাকায় এবং কিছু বড় ও নাম-করা হাসপাতালে এর খরচ পড়ে ১৬০০-২০০০ টাকা পর্যন্ত। ইউরিক এসিড টেস্টের ফি সরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবে নেওয়া হয় ২০০-৩৫০ টাকা। একই টেস্টে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খরচ হয় সাধারণত ৪০০-৭০০ টাকা, যা কিছু বড় ও নাম-করা হাসপাতালে নেওয়া হয় ৮০০-৯০০ টাকা পর্যন্ত। ইউরিন আএমই টেস্টের ফি সরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবে নেওয়া হয়ে থাকে ১৫০-২৫০ টাকা, যা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেওয়া হয় ৩০০-৬০০ টাকা এবং কিছু বড় ও নাম-করা হাসপাতালে যার সর্বোচ্চ খরচ ৭০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এমন মূল্য বৈষম্যের কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত রোগীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

নিয়ন্ত্রণ নেই, মানদ-ও প্রতিষ্ঠিত নয় : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘ফি নির্ধারণ ও মান নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা’ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা হয় না। বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা বলছেন, উচ্চ ভাড়া, সরকারি কর, যন্ত্রপাতির দাম এবং বিশেষজ্ঞ টিম পরিচালনার কারণে তারা নিজেদের মতো করে দাম নির্ধারণ করেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিকারকর্মীদের মতে, রোগী জিম্মি-পরিস্থিতির সুযোগে কেউ বাড়তি মুনাফা করছে, কেউ আবার প্রতিযোগিতার কারণে কম দিচ্ছে। সরকারের কার্যকর মূল্যসীমা না থাকায় ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

রোগীদের ক্ষোভ : রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকার বাসিন্দা আক্কাস মাহমুদ। কয়েকদিন থেকে ভুগছিলেন পেটের ব্যথায়। ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রামের পরামর্শ দিলে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে যান পরীক্ষা করাতে। সেখানে ১৮শ টাকা দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে এসে বাসার পাশের ইনসাফ বারকাহ হাসপাতালে গিয়ে শোনেন একই পরীক্ষার মূল্য মাত্র সাত শ টাকা। দামের এমন তফাতে কোন পরীক্ষার মান ভালো তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েন তিনি।

কিছুটা কম মূল্যে পরীক্ষার আশায় রাজধানীর শান্তিনগর পপুলার হাসপাতালে এমআরআই করাতে আসা সঞ্জয় মিত্র বলেন, ‘বেশ কয়েকটি বড় হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে মূল্য এত বেশি যে আমার সাধ্যের বাইরে। এখানে একটু কম তাই এসেছি। পপুলারের সুনামও আছে বাজারে। কিন্তু অন্যান্য হাসপাতালে কেন বেশি দাম রাখে তা বুঝি না। অসহায় রোগীর পকেট কেটে কি লাভ তাদের?’

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা : তবে একই পরীক্ষার মূল্য হাসপাতালভেদে ভিন্ন হওয়ার বিপক্ষে খোদ হাসপাতাল মালিকরাও। রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ চক্রবর্তী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এক্ষেত্রে সরকারকেই পরীক্ষার দাম নির্ধারণের জন্য ন্যূনতম-সর্বোচ্চ মূল্যসীমা ঠিক করে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, এটি যেন কার্যকর হয় এর জন্য সরকারি পর্যবেক্ষণ টিমের নিয়মিত মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। কোনো হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়নের সময় মূল্য বৈষম্যের তথ্য মূল্যায়ন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা রোগীদের সচেতন করতে অনলাইন মূল্যতালিকা বাধ্যতামূলক করতে হবে।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কয়েকবার বেসরকারি হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য নির্ধারণে নীতিমালা তৈরির ঘোষণা দিলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, এটি জটিল একটি ক্ষেত্র। আমরা কাজ করছি, তবে সব পক্ষের সমন্বয় জরুরি।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি ব্যবস্থার একধরনের ‘বিকল্প’ ভরসা হিসেবে গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ডায়াগনস্টিক সেবার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু এই বিপুল নির্ভরতা যতটা স্বাভাবিক, বাজারটি ততটাই নিয়ন্ত্রণহীন, স্বচ্ছতাহীন ও মানসম্মত মূলনীতিহীন। এমন বিশাল পার্থক্য শুধু রোগীর জন্য বিভ্রান্তিকর নয়, বরং একটি প্রশ্নও সামনে আনে মূল্য নির্ধারণের ভিত্তি কী? বাজার-অর্থনীতি, বিনিয়োগ খরচ, মেশিনের মান এসবের বাইরে আরও অনেক অদৃশ্য কারণই এখানে ভূমিকা রাখে। অনেক বেসরকারি হাসপাতালের মালিকপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য নির্ধারণে ব্যয় কাঠামো, কর্মীর দক্ষতা, যন্ত্রপাতির মানÑ এসবকে সামনে আনলেও বাস্তবতা আরও জটিল।’

কেন এই মূল্য পার্থক্য : হাসপাতালভেদে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য পার্থক্যের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠানে অপারেশন, আইসিইউ বা ইনডোর সার্ভিস লাভের মুখ দেখে না। সেই ঘাটতি পূরণ হয় ডায়াগনস্টিক সেবার আয় দিয়ে। এটা কার্যত একটি ক্রস-সাবসিডাইজেশন মডেল- যেখানে সবচেয়ে বেশি আয় আসে পরীক্ষার মাধ্যমে।

এছাড়াও যন্ত্রপাতির ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ একটি বড় বিষয় উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি হাসপাতালের স্বত্বাধিকারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘একই ধরনের ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স (এমআরআই) মেশিন হলেও ব্র্যান্ড, সফটওয়্যার আপডেট বা ইমেজ প্রসেসিং প্রযুক্তির ভিন্নতার কারণে দাম বাড়াতে হয়। এছাড়া, বড় করপোরেট হাসপাতাল বনাম স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টার দুই পক্ষের লক্ষ্য, ব্যয় ও গ্রাহকশ্রেণির পার্থক্য দামেও প্রতিফলিত হয়।

নেই কার্যকর নীতিমালা : বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য নিয়ে ২০১৬ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে তা আর কার্যকর হয়নি। দেশে কতগুলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে, তারা কী দাম নেয়, তাদের মান কেমন এসব নিয়ে কেন্দ্রীভূত ডাটাবেইস নেই।

ফলে সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাইভেট সেক্টরগুলোর একটি। মালিকদের সংগঠনগুলো মূল্য নিয়ন্ত্রণকে ব্যাবসায়িক স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এটিকে একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার। যদি নীতিমালা বাস্তবায়ন করা যায় তা হলে এ বৈষম্য থাকবে না বলে আমরা আশা করছি।’

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!