মাঘজৌজা সাদা। একসময় গাজা উপত্যকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেইত হানুনে থাকতেন তিনি। ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যুত হয়ে এখন তার ঠাঁই হয়েছে গাজা সিটিতে। ইসরায়েলিদের পক্ষ থেকে নতুন করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির হুমকির মুখে এ নারী বলেন, ‘দক্ষিণ আর নিরাপদ নয়। গাজা সিটিও নিরাপদ নয়। উত্তরাঞ্চলও নিরাপদ নয়। আমরা কোথায় যাব?’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘আমরা কি নিজেদের সাগরে ছুড়ে ফেলব?’ ত্রাণ আনতে যাওয়া ক্ষুধার্ত গাজাবাসীদেরও প্রতিদিন হত্যা করছে ইসরায়েল।
চরম পর্যায় পৌঁছেছে মানবিক সংকট। সীমান্ত বন্ধ থাকায় বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে ত্রাণ। দ্রুত ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে রেহাই পেতে চান ফিলিস্তিনিরা। স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, ‘ভেতরে পরিস্থিতি কঠিন। অনেকে হতাহত হচ্ছেন। খাবার আর জীবনের নিরাপত্তা চাই। ইসরায়েলি আগ্রাসনে আমরা ক্লান্ত।’ অন্য একজন বলেন, ‘সহায়তা আনতে গেলে প্রতিদিই গুলি চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এতে অনেকের প্রাণ যচ্ছে; এটি প্রকাশ্যে হচ্ছে, লুকানোর কিছু নেই।’ এর মধ্যে গাজা উপত্যকা দখলের পরিকল্পনাই দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার সবচেয়ে ভালো উপায় বলে মন্তব্য করলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা গাজায় থাকা হামাসের অবশিষ্ট দুটি শক্ত ঘাঁটি এবং কেন্দ্রীয় শিবির ভেঙে ফেলার জন্য আইডিএফকে নির্দেশ দিয়েছে।’
গাজার মধ্যাঞ্চলে বাস্তুচ্যুতদের একটি শিবিরে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৯ ফিলিস্তিনি নিহত ও আরও ১৩ জন আহত হন। ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিধ্বস্ত ছিটমহল গাজায় বোমাবর্ষণ চালিয়েই যাচ্ছে ইসরায়েল। তাদের বাহিনীগুলোর অব্যাহত হামলায় বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যেই অবরুদ্ধ ভূখ-টিতে এক শিশুসহ অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালের সূত্রগুলো ও উদ্ধারকারীদের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে আলজাজিরা। গাজা সিটির পশ্চিমে আনসার এলাকায় ইসরায়েলি ড্রোন থেকে চালানো গুলিতে এক শিশু নিহত হয়। এরপর গাজার মধ্যাঞ্চলে বাস্তুচ্যুতদের একটি শিবিরে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত নয় ফিলিস্তিনি নিহত হন। এ হামলায় আহত হয়েছেন আরও ১৩ জন। গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহ এলাকায় ড্রোন হামলার আরেক ঘটনায় আরও একজন নিহত হন। এখানে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন।
গাজায় দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলের অবিরাম হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৬৬ হাজার ১৪৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৬৮ হাজার ৭১৬ জন। টানা বোমা হামলায় পুরো গাজা ভূখ- ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আর কঠোর ইসরায়েলি অবরোধের কারণে ২০ লাখের বেশি বাসিন্দার ছিটমহলটিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এক দিনে আরও নিহত হয়েছেন অন্তত ৬৫ জন। অবরুদ্ধ নগরীর স্কুল, ঘরবাড়ি ও শরণার্থী শিবির রূপ নিয়েছে ধ্বংসস্তূপে, আর হাজারো মানুষ দক্ষিণাঞ্চলের দিকে পালিয়ে গিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় ইসরায়েলের অবিরাম হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ থামার কোনো লক্ষণ নেই। গত বুধবার ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অন্তত ৬৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদিকে হামাস যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। গত বুধবার গাজার জায়তুন এলাকার আল-ফালাহ স্কুলে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। যুদ্ধের কারণে আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তরিত হওয়া ওই স্কুলে শত শত বাস্তুচ্যুত মানুষ ছিলেন। হামলার পরপরই ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
কিন্তু উদ্ধারকাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটি হামলা হয় এবং এতে তারা গুরুতর আহত হন। আহতদের মধ্যে মুন্তাসির আল-দাহশান নামের এক কর্মী মারা যান। আল-আহলি আরব হাসপাতাল জানিয়েছে, এ ঘটনায় অন্তত ছয়জন নিহত ও আরও অনেকে আহত হয়েছেন। একই দিনে দারাজ মহল্লার একটি বাড়িতে হামলায় সাতজনের মৃত্যু হয়। জায়তুনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে আরেক হামলায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ নিহত ৬৫ জনের মধ্যে ৪৭ জনই গাজা সিটিতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। এদিকে ইসরায়েলের টানা বোমাবর্ষণে গাজার সবচেয়ে বড় এই শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন। ভেঙে পড়ছে আবাসিক ভবন ও স্কুল। হাজার হাজার মানুষ দক্ষিণের দিকে পালিয়ে যাচ্ছেন, তবে পথেও হামলার শিকার হচ্ছেন তারা।
এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) জানিয়েছে, গাজা সিটিতে তাদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে ডক্টরস উইদআউট বর্ডারস (এমএসএফ) একই ঘোষণা দিয়েছিল। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বুধবার গাজা শহরের বাসিন্দাদের দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করেছেন। কারণ, হামাস ফিলিস্তিনি ভূখ-ে প্রায় দুই বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা বিবেচনা করছে। গাজার নুসাইরাত থেকে এএফপি এ খবর জানিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা গাজার বৃহত্তম নগর কেন্দ্রে ভারী বোমাবর্ষণের খবর জানিয়েছেন। কারণ, ইসরাইল কাটজ সতর্ক করেছেন, সেনাবাহিনী শহরটির ঘেরাও আরো জোরদার করছে।কাটজ এক্স-এ পোস্টে বলেছেন, ‘গাজার বাসিন্দাদের জন্য দক্ষিণে সরে যাওয়ার এবং গাজা শহরে হামাস কর্মীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার এটিই শেষ সুযোগ।’ তিনি আরো বলেছেন, যারা থেকে যাবেন তাদের ‘সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসী সমর্থক হিসাবে বিবেচনা করা হবে’।