দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ও তাৎক্ষণিক আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) বা মোবাইল ব্যাংকিং। দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ মাধ্যমটি। প্রতি মাসেই রেকর্ড পরিমাণে লেনদেন বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। কিন্তু হঠাৎ করেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ‘নিষ্ক্রিয়’ হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে বর্তমানে বিকাশ, রকেট, নগদসহ ১৩টি এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য মতে, গত মে মাস পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধিত হিসাব সংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯০। কিন্তু তিন মাস আগে গত ফেব্রুয়ারিতে নিবন্ধিত সক্রিয় হিসাব ছিল ২৪ কোটি ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৩৩৪। অর্থাৎ এই সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ৯ কোটি ৫৪ লাখ ৬৭ হাজার ৭৪৪ নিবন্ধিত হিসাব ‘নিষ্ক্রিয়’ বা বন্ধ হয়ে গেছে।
জানা যায়, মানুষের হাতে থাকা মোবাইল ফোনই এখন ব্যাংক। মোবাইল ফোনটিই হয়ে উঠেছে সব ধরনের লেনদেনের অপরিহার্য মাধ্যম। এসব লেনদেনের হিসাব খুলতে কোথাও যেতে হয় না। গ্রাহক নিজেই অনায়াসে নিজের হিসাব খুলে লেনদেন করতে পারছেন। লেনদেন ছাড়াও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হচ্ছে অনেক নতুন নতুন সেবাও। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিলÑ অর্থাৎ সেবামূল্য পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোÑ অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রেরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া গাড়িচালক, নিরাপত্তাকর্মী ও গৃহপরিচারিকাদের বেতনও এখন দেওয়া হচ্ছে বিকাশ, রকেট ও নগদের মতো সেবা মাধ্যম ব্যবহার করে। পোশাক খাতসহ শ্রমজীবীরা এমএফএস সেবার মাধ্যমে গ্রামে টাকা পাঠাচ্ছেন। যার ফলে দিন দিন নগদ টাকার লেনদেন কমে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। মে মাসে এ মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে লেনদেন বেড়েছে ২৯ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা।
এদিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বাড়লেও নিবন্ধিত হিসাব বন্ধের পরিমাণ বাড়ছে। দেশে বর্তমানে বিকাশ, রকেট, নগদসহ ১৩টি এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সর্বশেষ তথ্য মতে, গত মে মাস পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধিত অ্যাকাউন্ট ১৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯০। কিন্তু তিন মাস আগে গত ফেব্রুয়ারিতে নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা ছিল ২৪ কোটি ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৩৩৪। অর্থাৎ এই সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ৯ কোটি ৫৪ লাখ ৬৭ হাজার ৭৪৪টি নিবন্ধিত হিসাব বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও সাধারণত একজন গ্রাহক একাধিক এমএফএস সেবায় হিসাব খুলতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঠিক কত নাগরিক এমএফএসের আওতায় এসেছেন, তা বলা যাচ্ছে না। তবে প্রতিটি পরিবারেই সেবাটি পৌঁছে গেছে।
এসব হিসাব বন্ধের অবশ্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমনÑ যদি একটি হিসাব নির্ধারিত সময় (সাধারণত ১৮০ দিন বা ৬ মাস) ধরে কোনো লেনদেন না করে, তাহলে সেটি ‘নিষ্ক্রিয়’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। গ্রাহক নিজে প্রয়োজনে বা নিরাপত্তার কারণে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে পারেন। নিয়ম লঙ্ঘন বা সন্দেহজনক কার্যক্রম সংঘটিত হলে হিসাবটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভোটার আইডি যাচাইয়ে সমস্যা হলে হিসাব সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ হতে পারে।
এ ছাড়া একজন ব্যবহারকারী একই এনআইডি দিয়ে একাধিক অ্যাকাউন্ট খোলার চেষ্টা করলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি বা একাধিক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিদিন বা মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেনের সীমা থাকে। যদি কেউ সেই সীমার বাইরে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে অতিরিক্ত লেনদেন করে, তা সন্দেহজনক মনে করে হিসাব ব্লক বা বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। কোনো ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে আদালত, পুলিশ বা বিএফআইইউ নির্দেশ দিলে তার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রয়াত গ্রাহকের পরিবারের অনুরোধে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা যেতে পারে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং খাতকে ডিজিটাল লেনদেনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে। তবে একাউন্ট ব্যবহারে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা বাধ্যতামূলক। যারা ৬ মাস বা তার বেশি সময় কোনো ধরনের লেনদেন করেন না, তাদের একাউন্ট ‘নিষ্ক্রিয়’ হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং প্রয়োজনে তা বন্ধও হতে পারে। এটি মানি লন্ডারিং বা সাইবার অপরাধ রোধের অংশ হিসেবেও বিবেচিত হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিলে ক্যাশ ইন হয়েছিল ৩২ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। মে মাসে ক্যাশ ইন হয়েছে ৪৫ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে ক্যাশ ইন বেড়েছে ১৩ হাজার ১৯ কোটি টাকা। তথ্য মতে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে উত্তোলন (ক্যাশ আউট) হয়েছিল ৩৮ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। মে মাসে উত্তোলন হয়েছে ৪৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে উত্তোলন বেড়েছে ৬ হাজার ২৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া মে মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা, বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ৮৯৬ কোটি, মার্চেন্ট পেমেন্ট বা পণ্য কেনাকাটায় ৭ হাজার ৪৩৩ কোটি ও রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৬৪৬ কোটি টাকার।
২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিংসেবা চালুর মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) যাত্রা শুরু হয়। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিংসেবা চালু করে বিকাশ।