ঢাকা বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫

করফাঁকির এশিয়াটিক গ্রুপও চায় করছাড়!

শাহীনুর ইসলাম শানু
প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০২৫, ০১:১৮ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্বর্ণ কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক গ্রুপ। এই গ্রুপ তাদের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে কর ফাঁকি দিলেও এবার ৪০ লাখ টাকা করছাড় পেতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে। আগারগাঁওয়ে এনবিআরের কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এনবিআর সূত্র জানায়, ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের কর ফাঁকি দিয়েছে এশিয়াটিক গ্রুপ। বিগত সময়ে সঠিক শুদ্ধাচারের ভেতর দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। সেই সুযোগে টাকা পাচারের বিষয়টিও অনুসন্ধান করে দেখছে এনবিআরের গোয়েন্দা সেল। এদিকে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে এশিয়াটিক গ্রুপের ১৭টি প্রতিষ্ঠান ও ৮ পরিচালকের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ রয়েছে।

এনবিআরের গোয়েন্দা সেল সিআইসির চিঠিতে উল্লেখিত এশিয়াটিকের ১৭টি প্রতিষ্ঠান হলো-এশিয়াটিক মিডিয়া লিমিটেড, এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশন লিমিটেড, এশিয়াটিক টকিং পয়েন্ট কমিউনিকেশনস লিমিটেড, এশিয়াটিক এক্সপেরিয়েনশিয়াল মার্কেটিং, অপটিমাম সার্ভিস লিমিটেড, এশিয়াটিক ইভেন্টস মার্কেটিং, মিডিয়া কমিউনিকেশন্স লিমিটেড, ফোরথট পিআর লিমিটেড, এশিয়াটিক মাইন্ড শেয়ার, এশিয়াটিক টিএমএস, ব্ল্যাকবোর্ড স্ট্র্যাটেজিজ, আউট অব দ্য ব্লু-ডিজাইন স্টুডিও (পূর্বতন কুকি জার), ধ্বনি চিত্র (পূর্বতন ধ্বনি রেকর্ডিং স্টুডিও), স্টেনসিল বাংলাদেশ, রেডিও স্বাধীন এবং ইস্ট এশিয়াটিক অ্যাডভারটাইজিং, এশিয়াটিক ইভেন্টস মার্কেটিং (পুনরায় তালিকাভুক্ত)।

এশিয়াটিকের পরিচালক হিসাবে যাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে তারা হলেনÑ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, প্রয়াত আলী যাকেরের স্ত্রী সারা যাকের, তাদের দুই সন্তান ইরেশ যাকের ও শ্রেয়া সর্বজয়া, ইকরাম মাঈন চৌধুরী, মো. মোরশেদ আলম, মোহাম্মদ হাসান ফারুক এবং মো. রেজাউল হাসান।

সিআইসির মতে, এশিয়াটিকের অভিযুক্ত পরিচালকরা তাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা সম্পদের তথ্য গোপন করে আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন। যদি এসব হিসাব থেকে টাকা তুলে ফেলা হয়, তবে রাজস্ব আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এজন্য আয়কর আইন ২০২৩-এর ২২৩(২) ধারা অনুযায়ী, অর্থ উত্তোলন ও স্থানান্তর স্থগিত রাখা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০৯-১৪ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে ভারতীয় সেনা ও তাদের পরিবারের নামে বরাদ্দকৃত স্বর্ণ এবং অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

মুজিব শতবর্ষ, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সফর, জয়বাংলা কনসার্ট এসব অনুষ্ঠানে প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ‘মুজিব’ সিনেমার প্রচারসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ইভেন্টেও অবৈধভাবে অর্থ ব্যবহার হয়। এখন পর্যন্ত সিআইসি এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ ও তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা বা অর্থদণ্ডসহ কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।

জানা যায়, এশিয়াটিক গ্রুপের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড়ও দিয়েছে এনবিআর। গ্রুপের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন, ইউটিলিটি বিল ও মূসক প্রদানে ব্যাংক থেকে টাকা তোলা যাবে। তবে প্রতিটি ইনভয়েসের বিপরীতে অর্থ উত্তোলনযোগ্য, তবে অতিরিক্ত টাকা তুলতে পারবে না। পাচারের আশঙ্কা থাকায় তা বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এনবিআর। এদিকে, এখনো এনবিআরের গোয়েন্দা সেলের বিশেষ নজরদারিতে গ্রুপের ১৭টি প্রতিষ্ঠান ও ৮ পরিচালক এবং তাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান চলমান।

এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অনুসন্ধান চলাকালেই অংশীপ্রতিষ্ঠান মাইন্ড শেয়ারের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের মধ্যে ৪০ লাখ টাকা করছাড়ের আবেদন করেছে এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষ। গ্রুপটির একাধিক কর্মকর্তা পূর্ব ঘোষিত নির্দেশনা ও সেই মোতাবেক নতুন আবেদনপত্র নিয়ে আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনে এনবিআর সদস্যদের ‘সুনজরের প্রার্থনা’ করছেন।

এশিয়াটিকের কর ছাড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর সদস্য জিএম আবুল কালাম কায়কোবাদ বলেন, ‘মূসক বাস্তবায়নে বিষয়টি যারা দেখেন, তারাই ছাড়ও দিতে পারেন। কেন, কোন প্রেক্ষাপটে করছাড়  দেওয়া হবেÑ এটা তাদের বিষয়। তবে আমি কারছাড়ের পক্ষে নই।’

একই বিষয়ে এনবিআরের অপর সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘ছাড় চাইতে আবেদন করতেই পারে। তবে অনুসন্ধান চলাকালে ছাড়ের আবেদন করায় প্রশ্ন উঠেছে।’ করছাড়ের বিষয়ে এনবিআরের মূসক বাস্তবায়ন ও পণ্য সেবা এবং পলিসি শাখা প্রচণ্ড নীরবতা পালন করছে। নির্দিষ্ট কর অঞ্চল থেকে আরও তথ্য সংগ্রহের অনুরোধ জানিয়েছেন দুই বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

ঢাকার কর অঞ্চল-১২ আওতাভুক্ত সার্কেল ২৪৫-এর একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঢাকার একটি কনসার্টের বিষয়ে তারা কর অব্যহতি চেয়েছেন। কিন্তু এখনো সার্কেলে আবেদনপত্র আসেনি। তবে মূসক আইনের ধারা ৯২ অনুযায়ী ‘মূসক ও প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্কমুক্তভাবে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা অভিযোগ আপত্তি উত্থাপিত হলে সে ক্ষেত্রে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধযোগ্য হবে।’ আইন অনুসারে একই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, কর ফাঁকি ও রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। নতুন করে ৪০ লাখ টাকা করছাড়ের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এনবিআরের অনেক রাজস্ব কর্মকর্তা।

করছাড় সম্পর্কে ঢাকার কর অঞ্চলের কর কমিশনার শাহ আলম শিকদার বলেন, ‘আবেদনপত্র এখনো কর অঞ্চলে আসেনি। কর অব্যাহতি শর্তের মধ্যে থাকলে বিষয়টি তারা অবশ্যই পাবেন। যদিও বিষয়গুলো সিআইসির নজরদারিতে রয়েছে।’

এদিকে, কর অঞ্চলের ২৪৫ নম্বর সার্কেলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত এপ্রিলে মাসে সিআইসির নির্দেশে সব ফাইল জমা দেওয়া হয়েছে। এখানে এশিয়াটিক গ্রুপের ৪-৫টি কোম্পানির সব ফাইল ছিল, তা জমা দেওয়ার পরে এনবিআর থেকে নতুন কোনো নির্দেশনা আসেনি। সাবেক সরকারের আমলে অনেক সুযোগ নিয়েছে, অনেক টাকা কর ফাঁকির ফাইলও রয়েছে।’

এশিয়াটিক গ্রুপের পরিচালক সারা জাকের রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের সবার ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। কর্মীদের বেতন ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয় মেটাতে কষ্ট হচ্ছে।’ ৪০ লাখ টাকার কর অব্যাহতির আবেদন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে এখনো আমি কিছু জানি না। আমি জেনে, তারপর আপনাকে জানাচ্ছি।’ এরপর তিনি আর কিছু জানাননি।

কর ফাঁকির বিষয়ে গ্রুপের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘গ্রুপের ইমেজে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুটি। স্বর্ণ আত্মসাৎ বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যদিকে, নির্দিষ্ট আয়ের ওপর সরকার রাজস্ব অবশ্যই পেয়েছে। তবে অভিযোগ ওঠার পরে দীর্ঘদিনের সেই সব নথিপত্র, প্রমাণাদি যা ছিল

কর ছাড় চায় আরও যেসব প্রতিষ্ঠান : একই সঙ্গে এনবিআরে কর ছাড় পেতে আবেদন করেছে কেএসআরএম পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড। তাদের আবেদনটি বিবেচনাধীন। ‘হ্রাসকৃত হারে উৎসে অগ্রীম আয়কর কর্তন’ না করতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি রানার অটোমোবাইলস পিএলসিও আবেদন করেছিল।

আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ সালের ১ জারুয়ারি পর্যন্ত পর্যন্ত ৫ বছরে জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে উৎসেকর অব্যাহতি দিয়েছে এনবিআর। নিজস্ব কারখানায় উৎপাদিত থ্রি হুইলার উৎপাদন ও বিক্রয় ব্যবসা থেকে অর্জিত আয়ের ওপর এই কর অব্যাহতি দিয়েছে এনবিআরের কর অব্যাহতি শাখা।