বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


হাসান আরিফ

প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২৫, ১০:৩৩ এএম

এলডিসি উত্তরণে নতুন চ্যালেঞ্জ

হাসান আরিফ

প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২৫, ১০:৩৩ এএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরণ করতে যাচ্ছে। এই উত্তরণ দেশের জন্য একটি মাইলফলক, যা উন্নয়ন, আয় বৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির প্রতীক। তবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আসছে নতুন চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হবে, যা চলতি বছরের আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ধরনের অভিঘাত আনতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি, যুক্তরাষ্ট্রে বিশাল বাজার দখল করে আছে। এই খাতে ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন, যাদের একটি বড় অংশ নারী। যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন শুল্কনীতি কার্যকর হলে, তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পাশাপাশি, পাট, চামড়া, হস্তশিল্প এবং হোম টেক্সটাইলের মতো অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। তবে এই চ্যালেঞ্জই ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে মোকাবিলা করা যায়। প্রয়োজন অর্থনৈতিক ক‚টনীতি, বাজার বহুমুখীকরণ, রপ্তানিতে গুণগত মান বাড়ানো এবং পারস্পরিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আগামী ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সাথে জাপানের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) হতে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হলেও জাপানে বাণিজ্য বাধার মধ্যে পড়বে না। এখন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বাধার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বড় অর্থনৈতিক দেশগুলোর সাথে এই ধরনের বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। যাতে বাংলাদেশের জন্য নতুন বাণিজ্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়, যেখানে রপ্তানি ও বিনিয়োগ একসঙ্গে প্রবাহিত হবে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশগুলোর সঙ্গে সমতাভিত্তিক চুক্তি অংশীদারত্বের পথকে সুগম করবে। যা মধ্যম উন্নত দেশের পথে বাংলাদেশের যাত্রায় একটি বড় ভিত্তি গড়ে দেবে।

শুল্কের পটভূমি: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন বলেছে, বাংলাদেশ আর স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা ভোগ করতে পারবে না। তাই অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশকেও পূর্ণাঙ্গ শুল্ক দিতে হবে। এই ‘রিসিপ্রোকাল ট্রেড’ বা পারস্পরিক বাণিজ্যনীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ বেশকিছু পণ্য শুল্কমুক্ত বা স্বল্প শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে পারত। এখন সেই সুবিধা বাতিল হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে হুমকির মুখে পড়বে। ইতোমধ্যে কয়েকটি বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড অর্ডার স্থগিত করেছে। ভারতের মতো প্রতিদ্ব›দ্বী দেশগুলো এ সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশী ভারত ও ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক বিক্রি করতে গিয়ে ব্যাপক মূল্যে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।

ক্ষতির আশঙ্কা: বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, এই শুল্ক কার্যকর হলে অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রপ্তানি হ্রাস পেতে পারে। এতে হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত। তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল ব্যাংকিং, পরিবহন, বিমা এবং হোটেল খাতেও এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

বিজিএমইএর প্রাক্তন সভাপতি রুবানা হক বলেন, এই শুল্কব্যবস্থা কার্যকর হলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। কর্মসংস্থান, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তিনি আরও বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অবস্থান ধরে রেখেছি। এই মুহূর্তে এ রকম শুল্কের বোঝা আমাদের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ৩৫ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের মতো দেশকে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্য থেকে ছিটকে ফেলবে। এটি আমাদের রপ্তানি সক্ষমতায় বড় ধরনের আঘাত হানবে।

বিশ্বব্যাংকের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি ক্ষতি হতে পারে। একই সাথে চাকরি হ্রাস, শ্রমিক অসন্তোষ এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিপি) এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এই ধরনের শুল্ক বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার যাত্রাপথে বড় ধাক্কা দিতে পারে।

বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান: সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক‚টনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলোচনায় বসেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক মওকুফ অথবা বিশেষ সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছেÑ

মার্কিন পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি: বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, গম, সয়াবিন, মেডিকেল যন্ত্রপাতি, গ্যাস টারবাইন, বোয়িং কোম্পানির বিমান এবং সেমিকন্ডাক্টর জাতীয় প্রযুক্তিপণ্য আমদানি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক হ্রাসের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের তৈরি গার্মেন্টসে মার্কিন তুলা ব্যবহারে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার চিন্তাও রয়েছে।

কাস্টমস ও বন্ড সুবিধা: যুক্তরাষ্ট্রের কটন আমদানির ক্ষেত্রে বন্ড সুবিধা বৃদ্ধি, কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং দ্রæত ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে বাংলাদেশ।

নন-ট্যারিফ বাধা হ্রাস: আমদানিকৃত মার্কিন পণ্যের ক্ষেত্রে নানা প্রশাসনিক ও অপ্রযোজ্য বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশের। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দ দেওয়ার কথাও আলোচনায় এসেছে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছি যে, আমরা কেবল সুবিধা নিতে আসিনি, আমরা পারস্পরিক বাণিজ্য স¤প্রসারণ চাই। আমরাও মার্কিন পণ্যের বাজার করে দিতে প্রস্তুত। তিনি জানান, বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির পথে হাঁটতে।

বিকল্প বাজার ও বৈচিত্র্য: যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বাংলাদেশ এখন নতুন বাজার অনুসন্ধানে মনোযোগী হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার কিছু দেশে রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় সুবিধা। পাশাপাশি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার বাজারেও প্রবেশাধিকার বাড়ানোর কার্যক্রম চালু হয়েছে।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ইতোমধ্যে আফ্রিকার দেশগুলো এবং দক্ষিণ আমেরিকার বাজারে বাণিজ্যিক প্রতিনিধি পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে। এ ছাড়া, চীন, তুরস্ক এবং সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের সঙ্গে রপ্তানিবান্ধব চুক্তি বাংলাদেশকে আঞ্চলিক বাণিজ্য সুবিধা এনে দিতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) চূড়ান্ত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ), যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বা শুল্কহ্রাসকৃত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হবে। যা অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হবে। আগামী ডিসেম্বর মাসে জাপানের রাজধানী টোকিওতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। ভারতের সাথে এ-সংক্রান্ত আলোচনা জাপান আগে শুরু করলেও আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। তবে আরও কয়েকটি দেশের সাথে আলোচনা চলমান। বাণিজ্য বাধা দূর করতে এই জাতীয় চুক্তি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিবে বলে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও প্রস্তুতি: বাণিজ্য সংকট বাংলাদেশের জন্য একপ্রকার সুযোগও হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি দেশকে একতরফা পোশাক খাতনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে রপ্তানির বৈচিত্র্য আনার দিকে মনোযোগী করবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প, ওষুধ, চামড়া, প্লাস্টিক, কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্যসহ নতুন খাতে রপ্তানি প্রসারে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারের জন্য টেকসই উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তোলারও সুযোগ তৈরি হবে বলে তাদের ধারণা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ করে, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে। সেজন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়, গবেষণাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠন।

সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও প্রয়োজন নতুন সুযোগ খুঁজে বের করা ও উদ্ভাবনী চিন্তা প্রয়োগ করা। পাশাপাশি শ্রমিকদের সুরক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান স্থায়িত্ব নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। তখনই সম্ভব হবে এই সংকটকে পরিণত করা একটি সফল উত্তরণে।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!