ঢাকা রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫

মজুত ফুরাচ্ছে, জ্বালানী সংকটের শঙ্কায় দেশ

স্বপ্না চক্রবর্তী
প্রকাশিত: জুলাই ১২, ২০২৫, ০১:৫০ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় দ্রুত মজুত ফুরিয়ে আসছে। সরকারের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, এখন খনিটির মজুতের একেবারে শেষদিকের গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। নতুন অনুসন্ধানে কূপগুলোতে গ্যাস না পাওয়া গেলে সামনে ভয়াবহ জ্বালানি সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দ্বীপজেলা ভোলায় গ্যাস থাকলেও তা জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না পাইপলাইন না থাকায়। এদিকে দেশের একমাত্র তেল মজুতকারী ইস্টার্ন রিফাইনারিরও মজুত সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এমন পরিস্থিতিতে দেশ খুব শিগগিরই জ্বালানি সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গ্যাস মজুতের সার্বিক অবস্থা

২০২৪ সালের শেষে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মোট মজুত ছিল ৩০.১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট, যার মধ্যে ১৯.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট ব্যবহার হয়ে গেছে। জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মোট অনুমিত মজুত আছে ২৮.৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট, যার প্রায় ২০.৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলিত, বাকি প্রতিস্থাপনযোগ্য মজুত মাত্র ৭৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।

দেশে শিল্প, বিদ্যুৎ ও গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন খাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস; কিন্তু উৎপাদন মাত্র ২,৭০০ এমএমসিএফডি গ্যাস। যার ফলে প্রতিদিন ঘাটতি থাকছে প্রায় ১,১০০ এমএমসিএফডি গ্যাস। 

উৎপাদন হ্রাস ও সংকটের ধরন।

এমন পরিস্থিতিতে দেশীয় উৎপাদন ক্রমাগত কমছে। যেমনÑ ২০২৫ জুনে তিতাস, বিবিয়ানা ও অন্যান্য প্রকল্পে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন মাত্র ১৮২ এমএমসিএফডি গ্যাস। যেখানে চাহিদা রয়েছে ৩৮০ এমএমসিএফডি গ্যাসের। বর্তমানে গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২৭০-২৮০ এমএমসিএফডি গ্যাস। যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

গত ৩০ জুন পেট্রোবাংলা বিবিয়ানার খনিগুলো থেকে মোট ১ হাজার ৮৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিবিয়ানা একাই সরবরাহ করেছে ৯২৭ মিলিয়ন ঘনফুট, যা মোট সরবরাহের ৫০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ খনিটি এখনো দেশের গ্যাস সরবরাহের প্রধান ভরসা। হঠাৎ করে এর উৎপাদন কমে এলে সারা দেশে গ্যাস সংকট দেখা দিতে পারে। একই অবস্থা অন্য খনিগুলোরও।

দেশে এখন পর্যন্ত মোট ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে, যার মধ্যে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিয়মিত গ্যাস উত্তোলন চলছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স), পেট্রোবাংলা এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এসব ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। পেট্রোবাংলার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট গ্যাসের যে মজুত বর্তমান ব্যবহারের হারে তা আগামী ৯-১০ বছর পর্যন্ত চলবে।

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির নিয়ন্ত্রণ ও ঝুঁকি: স্থানীয় উৎপাদন ঘাটতি পূরণে এলএনজির ওপর বাড়ছে নির্ভরতা। তবে এলএনজি আমদানির কেউ ঝুঁকি, বিশেষ করে এলএনজি টার্মিনালের মেইনটেনেন্স কিংবা খারাপ আবহাওয়া হলে সংকট আরও তীব্র হয়।

সম্প্রতি বৈরী আবহাওয়ার কারণে কক্সবাজারের মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে অবস্থিত টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কমে যায় গ্যাসের চাপ। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দুই এলএনজি টার্মিনাল থেকে ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার সক্ষমতা থাকলেও দৈনিক গড়ে ৮০-৯০ ঘনফুট সরবরাহ করা হয়। 

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা এবং দেশীয় উৎপাদিত গ্যাস থেকে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কোনো কারণে সরবরাহ কমলেই বেড়ে যায় সংকট।

দেশীয় এবং আমদানি উৎস থেকে বর্তমানে সারা দেশে দৈনিক সরবরাহ হচ্ছিল ২৭১ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাস উৎস থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। বাকিটা আমদানীকৃত এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছিল।

কিন্তু চাহিদামতো এলএনজি সরবরাহ করতে না পারায় সংকট দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুটে। ফলে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আবাসিক খাতেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। তবে সরকার আগস্টের মধ্যে শিল্পক্ষেত্রে চারটি অতিরিক্ত এলএনজি কার্গো সরবরাহ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। 

তেলের মজুত ও আমদানি

দেশে প্রতিবছর জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ টন। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশজুড়ে তেলের মজুত সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত থাকে, তবে ডলারের অভাব আমদানিতে জটিলতা সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধাবস্থার মধ্যেও দেশে দেখা দেয় তেলের সংকট।

এসব কারণে শিল্প উৎপাদন ও বৈদ্যুতিক সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ব্যবসায়িক ক্ষতির ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া লোডশেডিং বাড়ছে, গ্যাস-সংকট বৈদ্যুতিক উৎপাদন এবং গৃহস্থালিসহ শিল্প খাতের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।

কমেছে শিল্প উৎপাদন

গ্যাস সংকটে দেশের বড় শিল্প-কারখানাগুলোতে কমেছে উৎপাদন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে তৈরি পোশাকশিল্প। এই খাতে গড়ে উৎপাদন কমেছে শতকরা ২০-৩০ ভাগ। আবার যারা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট ব্যবহার করছেন, তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। বাজার থেকে চড়া দামে জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে তাদের। উৎপাদন কমে যাওয়া ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

এসব বিষয় নিয়ে বিকেএমইএ’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ফজলে শামীম এহসান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের কারখানাগুলোতে উৎপাদন ৫০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। গ্যাস না থাকার কারণে ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলো সময়মতো এবং চাহিদামতো ফেব্রিক সরবরাহ করতে পারছে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এখন তার ক্যাপাসিটির ৫০ ভাগের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বার্ষিক ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে কাতারের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। ১৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিকমূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহ ঘাটতির কারণে কম খরচে জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে সরকার। 

সংকট উত্তরণে সরকারের যত পরিকল্পনা

তবে এই সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশীয় কূপ খননে জোর দেওয়ার পাশাপাশি আমদানি বাড়াতেও নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল পরিচালনায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে স্বীকার করে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আবহাওয়ার ওপর তো আমাদের কারো হাত নেই।

এর আগেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টার্মিনালগুলো বন্ধ করতে হয়েছে। ফলে গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। তাই আমরা স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছি। আশা করছি, এ বছরেই স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় এর সুফল ঠিক কবে নাগাদ পাওয়া যাবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে গ্রাহকদের ভোগান্তি কমাতে সরকার অবশ্যই এটি করবে। 

এদিকে স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি আমদানি বাড়াতেও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বাড়ানো হচ্ছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। প্রতিযোগিতা বাড়াতে অর্থাৎ সর্বনিম্ন দর পেতে আরও ৩৩ কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমদানির অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

ফাওজুল কবির খান বলেন, যেহেতু দেশীয় কূপগুলোয় এখনো নতুন করে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না, তাই প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে আমাদের আমদানিই করতে হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এ ক্ষেত্রে যেন সর্বনিম্ন দামে পাওয়া যায়। আপনারা জানেন, স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে এলএনজি ক্রয়ে বিগত সরকারের বদান্যতায় ভিটোল, গানভর, এক্সিলারেট এনার্জি, সামিটসহ গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে আমদানির প্রক্রিয়া জিম্মি ছিল।

আমরা সেই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এখন উন্মুক্ত দর প্রস্তাবের মাধ্যমে আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়াতে চাইছি। ইতিমধ্যে এলএনজি সরবরাহের জন্য আরামকো, শেল, বিপির মতো জ্বালানি খাতের ৩৩টি জায়ান্ট কোম্পানি আবেদন করেছে। উন্মুক্ত দরপত্রের এটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা। আমরা আরও উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরবরাহকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে আরও খরচ বাঁচাতে চাই।

গ্যাস সংকট কাটাতে দেশীয় কূপগুলোতে খনন কার্যক্রম বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদেরও। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বতর্মান সরকার বিগত সরকারের আমলে গলা পর্যন্ত হওয়া দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছে। ইচ্ছি করলেই সেই গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নিজেদের আখের গোছাতে তাদের পছন্দমতো কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করত। এবার যেহেতু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন কোম্পানি আসছে, সেহেতু আমদানি করা এলএনজির মূল্য কম হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে আমি মনে করি। আশা করছি বৈরী আবহাওয়া কয়েক দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু স্থায়ী সমাধান জরুরি।