২০২২ সালে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগ পান সাইফুল ইসলাম সরকার। এমডি হওয়ার পরপরই খনির ১ হাজার ১০০ কোটি টাকারও বেশি স্থানীয় আমানত ফিক্সড ডিপোজিট রেশিও (এফডিআর) তার এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখেন।
শুধু তাই নয়, বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে এসব এফডিআর খোলা এবং নবায়ন করার ক্ষেত্রে তিনি একটি নির্দিষ্ট হারে নিয়েছেন সুবিধাও। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজা হিসেবে পরিচিত আলমগীর হোসেনকে বড় অংকের ঘুষের বিনিময়ে দিয়েছেন খনির মূল্যবান স্ক্র্যাপ মালামাল। ৮০ কোটি টাকা মূল্যের স্ক্র্যাপ নামেমাত্র মূল্যে তার হাতে তুলে দেন কয়লাখেকো সাইফুল।
ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হয়েও এখনো কীভাবে ক্ষমতায় টিকে রয়েছেন সব ম্যানেজ করা এই ম্যানেজম্যান তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্টদের মনে। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসারও দাবি তাদের। অভিযোগ পাওয়া যায়, কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিপুল পরিমাণ ঘুষের বিনিময়ে শিডিউলবহির্ভূতভাবে স্ক্র্যাপের পাশাপাশি তামার তারও পাচার করেছেন সাইফুল ইসলাম সরকার।
সাইফুলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষের বিনিময়ে খনির ৮০ কোটি টাকা মূল্যের স্ক্র্যাপ মালামাল নামমাত্র মূল্যে তুলে দেন সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজা হিসেবে পরিচিত আলমগীর হোসেনকে। এ কাজে পাত্তা দেননি কোর্টের নিষেধাজ্ঞাকেও। শুধু তাই নয়, বিপুল পরিমাণ ঘুষের বিনিময়ে শিডিউলবহির্ভূত মূল্যবান তামার তারও পাচার করার অভিযোগ আছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সরকারের বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খনির এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ২০২৩ সালে বিদেশ সফরের নামে খনির অর্থের অপচয়, এজিএম অনুষ্ঠানের ব্যয়ে অনিয়ম এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে ১৮ থেকে ২০ জন জনবল নিয়োগ দিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন ও তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ আদায় করেন তিনি। তিনশ দিন অফিসের কাজের জন্য ঢাকায় অবস্থান দেখিয়ে টিএডিএ বাবদ কোম্পানি থেকে ৪০ লাখ টাকা আদায় করেছেন তিনি।
শুধু তাই নয়, এমডি সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে কয়লাখনি এলাকার জন্য গঠিত সিএসআর ফান্ডের টাকা ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীরের প্রতিষ্ঠানে প্রদান করে তছরুপ করেছেন। এমনকি সিএসআর ফান্ডের টাকা কয়লাখনির এলাকায় না দিয়ে অন্য জায়গায় দেন তিনি। সোনালী ব্যাংক পিএলসি বড়পুকুরিয়া প্রকল্প শাখায় ২০১১ সালে খোলা এমডির ব্যক্তিগত সঞ্চয় হিসাব নম্বরে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণপত্র এসেছে রূপালী বাংলাদেশের হাতে।
২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব বিবরণীতে দেখা যায়, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তার হিসাব নম্বরে কোটি টাকার ওপরে জমা পড়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে পেট্রোবাংলা একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে। কিন্তু সেই কমিটির রিপোর্ট এখনো আলোর মুখ দেখেনি। কমিটি ওই রিপোর্ট কবে প্রকাশ করবে তা কেউ জানে না বা আদৌ কোনো দিন প্রকাশ হবে কি না সেটাও কারো জানা নেই।
স্বজনদের ব্যবহার করেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাইফুল ইসলাম সরকার অধিকাংশ সময় ঘুষের টাকা নিয়েছেন নগদ অর্থে। তবে নিজ এলাকা বগুড়ার একটি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেও নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংক বগুড়া শাখার নিগাত সিমার হিসাব নম্বর (১০১৪০০১৪৯৩৬৭০) ব্যবহার করে ৩০ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যাংকের পাশাপাশি নিকটাত্মীয় সুরুজ্জামান সরকার ও উজ্জ্বল হোসেনের মাধ্যমেও নগদ টাকা গ্রহণ করেন। কখনো কখনো নিজেই রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত তার বাসার এলাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বসে লেনদেন করেছেন। যার ছবি এসেছে রূপালী বাংলাদেশের হাতে। ছবিতে দেখা যায়, ব্যাংকের কাউন্টারের সামনে টাকা বুঝে নিচ্ছেন তার ঘনিষ্ঠ লোক উজ্জ্বল হোসেন। এরপর লাল রঙের ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেখা যায় তাকে।
এমডির ঘনিষ্ঠ উজ্জ্বল হোসেন (পিতা-মো. রাজিব) বগুড়া সদর উপজেলার কর্নপুর গ্রামের বাসিন্দা। আর নিকটাত্মীয় সুরুজ্জামান সরকার বগুড়ার ফুলবাড়ি থানার মধ্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। সুরুজ্জামানকে (পিতা আকবর আলী) সবাই এমডির ভাই বলেই জানেন। কিন্তু তিনি তার আপন নাকি পারিবারিক সূত্রের ভাই তা জানা যায়নি।
ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজাকে দিয়েছেন বিশেষ সুবিধা
নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পলাতক সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজা পরিচয় দিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো আলমগীর হোসেনকে (পিতা-আব্দুল খালেক) দিয়েছেন বিশেষ সুবিধা। চট্টগ্রামের সীতাকু- উপজেলার খাদেমপাড়ার বাসিন্দা হলেও দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি এলাকায় ওবায়দুল কাদেরের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে বেড়ানো এই আলমগীরকে এখনো বিশেষ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন সাইফুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের পুরো সময়টা জুড়েও ছিল তার রাজত্ব। তার ইশারা ছাড়া এমডি কোনো কাজই করতেন না। অভিযোগে প্রকাশ, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্ক্র্যাপ মালামাল হস্তান্তর না করতে ৮ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনা অমান্য করে পরের দিনেই স্ক্র্যাপ সরবরাহ করেছেন সাইফুল ইসলাম সরকার।
আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে এখনো বহাল চাকরিতে
সাইফুল ইসলাম সরকার আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ২৫ বছর ধরে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কাজ করছেন। চাকরির সুবাদে অনিয়ম দুর্নীতি করে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার বিরুদ্ধে কোম্পানির স্থায়ী আমানত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে (পদ্মা ব্যাংক) রেখে ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়া, সরকারি গাছ বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ, কয়লা বরাদ্দের মাধ্যমে কমিশন গ্রহণ করার অভিযোগ রয়েছে। যার মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়া এমডি সাইফুল ইসলামের রয়েছে বগুড়ার ফুলবাড়ি মহিলা কলেজের সামনে ৫ তলা ভবন, ঢাকার মিরপুর-২ নম্বর স্টেডিয়াম এলাকায় বিশাল সাইজের ফ্ল্যাট।
অভিযোগ তদন্তে দুদক
কয়লাখেকো নামে পরিচিত এই সাইফুল ইসলামের দুর্নীতির বিষয়ে ইতোমধ্যে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের দিনাজপুর জেলা কার্যালয় থেকে উপপরিচালক আতাউর রহমান সরকার স্বাক্ষরিত এক পত্রে সাইফুল ইসলাম সরকারের বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই চিঠিতে বেশকিছু বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে তার কাছে। চিঠিতে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা স্থায়ী আমানতের তথ্য, কয়লা খনির শ্রমিকদের বেডশিট ও ছাতা প্রদানের বিষয়ে তথ্য, আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগের তথ্য, দিঘীপাড়া কয়লা খনির জরিপ কাজ, হাকিমপুর লোহা খনির ফিজিক্যাল স্ট্যাডি নামীয় প্রকল্প-২ ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
তদন্তে নেমেছে পেট্রোবাংলাও
সাইফুল ইসলামের স্ক্র্যাপ টেন্ডার দুর্নীতির বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আব্দুল মান্নান পাটোয়ারীকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। অতীতে দেখা গেছে, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সাইফুল ইসলাম সরকারের বিষয়ে অনেকটা উদার পেট্রোবাংলা। তাকে দায়িত্বে বহাল রেখেই তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার উপমহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন ও বিপণন) ডা. বেলায়েত হোসেন জানান, তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরও করা হয়েছে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির আরেক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘কাক কাকের মাংস খায় না এমন একটা প্রবাদ আছে। সাইফুল ইসলাম সরকার ম্যানেজম্যান হিসেবে সবার সেরা। না হলে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া সব এমডি বিদায় হলেও তিনি এখনো বহাল থাকেন কি করে। আবার সুধা সদনের ঘনিষ্ঠজনরা এই সময়ে এসে টেন্ডার পায় কি করে। তাও আবার গোপন লিমিটেড টেন্ডারে।’
তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের সব খাতে সংস্কারকাজ চলমান। কয়লাখনির দুর্নীতির বিষয়ে যেহেতু তদন্ত চলছে সেহেতু এটি নিয়ে এখনই কিছু বলছি না। তবে দুর্নীতি প্রমাণ হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেও বহাল সাইফুল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রীয় প্রায় সব কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সরানো হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময় মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো সাইফুল ইসলাম সরকার রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। কথিত রয়েছে তিনি যেমন নিতে জানেন, তেমনি উপরের দিকে ঢালতেও সিদ্ধহস্ত। যে কারণে অন্যান্য এমডিরা চলে গেলেও তিনি বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন। সরকারের পট পরিবর্তনের পর তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও উপরতলার জোরে পার পেয়ে যাচ্ছেন বারবার। গত বছরের ২৫ আগস্ট খনি মুখে তার বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন ফুলবাড়ী-পার্বতীপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। এরপর জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হলেও কোনো কাজে আসেনি।
সব অভিযোগ অস্বীকার করলেন সাইফুল
তবে নিজের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাইফুল ইসলাম সরকার। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও আমি নিজ যোগ্যতায় স্বপদে বহাল রয়েছি। একটা মহলের এটা সহ্য হচ্ছে না। তাই আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় নানা অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে। তদন্ত তো হচ্ছেই। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে আমি মেনে নেব।
আপনার মতামত লিখুন :