অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনের স্বপ্ন দেখতেন কামাল হোসেন পিন্টু। তিন মেয়ে, বাবা-মা ও পরিবারের স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়েই পা রেখেছিলেন সেই যাত্রায়। কিন্তু এখন তিনি নিঃস্ব ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা দিয়েছেন, অথচ এখন তার নেই কিছুই। তার মতো আরও অন্তত ১৮ জন ভুক্তভোগী কোটি কোটি টাকা হারিয়েছেন মাসুম রেজার প্রতারণার শিকার হয়ে। আর এই প্রতারণার অর্থ লেনদেনের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে মোহাম্মদ আলী নামের এক ব্যক্তি। রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী স্থানীয়ভাবে পরিচিত মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট হিসেবে। তার প্রতিষ্ঠান ‘বিসমিল্লাহ টেলিকম’-এর আড়ালে তিনি পরিচালনা করে আসছেন অবৈধ অর্থ লেনদেন ও হুন্ডি ব্যবসা। বিকাশ, নগদসহ মোবাইল ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি মোবাইল সার্ভিসিং এবং এক্সেসরিজ বিক্রির আড়ালে চলছে এই অপরাধচক্রের লেনদেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, গত ৫ বছরে মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে প্রায় ২৫ কোটি টাকা পাচার করেছেন মাসুম রেজা। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটিও ইউরোপের ভিসা তিনি দেননি। বরং অনেকেই হয়েছেন সর্বস্বান্ত।
রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মোহাম্মদ আলীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘বিসমিল্লাহ টেলিকম’-এর ব্যাংক হিসাব ও মোহাম্মদ আলীর নামে থাকা ৭টি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। এর মধ্যে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের চৌমুহনী শাখায় মোহাম্মদ আলীর নামে রয়েছে ২টি ব্যাংক হিসাব। এর মধ্যে একটি তার ব্যক্তিগত। যার হিসাব নাম্বার ৮৭-৩। অন্যটি তার প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ্ টেলিকমের নামে। হিসাবটির নাম্বার ৬৭-৯।
নোয়াখালীর চাটখিলে রূপালী ব্যাংকের কড়িহাটি বাজার শাখায় রয়েছে বিসমিল্লাহ টেলিকমের আরেকটি ব্যাংক হিসাব। যার হিসাব নাম্বার ০৩-৪। সিটি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকে মোহাম্মদ আলীর নামে থাকা ব্যাংকটির হিসাব নাম্বার ১০-১। ব্র্যাকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়েও তার একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার হিসাব নং-০০-১। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের চৌমুহনী শাখায় মোহাম্মদ আলীর ব্যাংক হিসাব নং ৮৭-৩। এ ছাড়া বিসমিল্লাহ টেলিকমের একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে ইসলামী ব্যাংকে। যার হিসাব নং ৪৫-৪। (নিরাপত্তার স্বার্থে পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসাবের নাম্বার উপস্থাপন করা হয়নি।)
রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪ সালের ২০ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২১ জুলাই পর্যন্ত মোহাম্মদ আলীর বিসমিল্লাহ টেলিকমের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের চৌমুহনী শাখায় প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। একটি মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিশাল অংকের লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ভুক্তভোগীদের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৩০ অক্টোবর ২০২৪ সালের পর থেকে চলতি বছরের ১৯ মার্চ পর্যন্ত ডাচ-বাংলার বিসমিল্লাহ টেলিকমের ব্যাংক হিসাবে ৪৭ লাখ ১০ হাজার টাকা জমা দিয়েছেন রূপালী বাংলাদেশের কাছে অভিযোগ করা ভুক্তভোগীরা। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর বিসমিল্লাহ টেলিকমের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ভুক্তভোগী এক গ্রাহক ২ লাখ টাকা জমা দেন। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর একই অ্যাকাউন্টে ২ লাখ টাকা জমা দেন আরও দুইজন। ১৯ ডিসেম্বরেও ২ লাখ টাকা জমা দেন এক গ্রাহক।
এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা পড়ে ডাচ-বাংলার ওই ব্যাংক হিসাবে। এ ছাড়া মার্চ মাসে মোহাম্মদ আলীর বিসমিল্লাহ টেলিকমের ডাচ-বাংলার ব্যাংক হিসাবে জমা পড়ে সাড়ে ৬ লাখ টাকা।
ভুক্তভোগী কামাল উদ্দিন পিন্টুর বোন শিল্পী আক্তার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল ভিয়েতনাম নিয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে আমার ভাইকে অস্ট্রোলিয়া বা ইউরোপে নিয়ে যাবে। মোহাম্মদ আলীর নিজস্ব ব্যাংক হিসাব ও তার প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ টেলিকমের ব্যাংকে টাকা পাঠাতে বলা হয়। পরে শুনি আমার ভাইয়ের মুক্তিপণ হিসাবে এই টাকা নিয়েছে।
তিনি বলেন, মোহাম্মদ আলীর সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের চৌমুহনী শাখার (৮৭-৩) হিসাবে ১২ লাখ টাকা জমা দেই। এ ছাড়া বিসমিল্লাহ টেলিকমের ইসলামী ব্যাংকে (৪৫-৪) ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা জমা করি।
অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, এ ধরনের কার্যকলাপ স্পষ্টভাবে মানি লন্ডারিংয়ের আওতায় পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বড় অংকের নগদ লেনদেন, বিদেশ গমনপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় এবং কোনো বৈধ সেবার বিপরীতে না থাকাÑ এই তিনটি মিলেই মানিলন্ডারিং আইনের ৪ ও ৫ ধারা অনুযায়ী অপরাধ।
মোহাম্মদ আলীর ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হওয়া অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কে বা কারা আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছে তা আমার জানা নাই। অনেকেই আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠান।
ইউরোপে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আপনার অ্যাকাউন্টে টাকা নেওয়া হয়েছে জানানো হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কেউ কখনো অভিযোগ করে নাই। আমি এর বেশি জানি না।
তাহলে কি আপনে হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি হুন্ডি ব্যবসা করি না। আমি বিকাশ-নগদে লেনদেন করি।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক মো. আল আমিন বলেন, মানব পাচারকারীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনা উচিত। এই চক্রগুলো দেশের তরুণদের প্রলোভন দেখিয়ে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। এক একটা তরুণ নিঃস্ব হওয়ার সঙ্গে তার পরিবারও বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। তাই দ্রুততম সময়ে আইনের প্রয়োগ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি। বর্তমান সময়ে মানিলন্ডারিং অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু এখনো কিছু অসাধু লোক আছেন যারা হুন্ডি ও মানিলন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
সিআাইডির এসএসপি সিরিয়াস ক্রাইম মো. বদরুল বলেন, কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছেন যারা বিকাশ, নগদের ব্যবসার আড়ালে হুন্ডি ও মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে। বিষয়গুলো আমাদের নজরদারিতে আছে। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে বা অভিযোগ পেলে আমরা তদন্তপূর্বক তাদের আইনের আওতায় আনি।
আপনার মতামত লিখুন :