জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে ঘোষিত ‘জুলাই সনদ’ এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য, অবিশ্বাস এবং পদ্ধতিগত জটিলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও আরও কয়েকটি দল সনদের খসড়া নিয়ে তীব্র আপত্তি তুলেছে, যার ফলে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২১তম দিনের সংলাপে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এই বিভাজন।
পদ্ধতিগত অসঙ্গতি ও আইনি নিশ্চয়তার দাবি এনসিপির সংলাপের বিরতিতে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, আমরা এটির তীব্র বিরোধিতা করছি। আলোচনার পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা হয়নি, অথচ তারা হঠাৎ করে খসড়া প্রকাশ করেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি অভিযোগ করেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ছয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির কথা বললেও কোন পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত হবে, তা নির্ধারণ না করেই খসড়া প্রকাশ করেছে। এটা একতরফা পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জাবেদ রাসিন আরও বলেন, নির্বাচনের আগে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর আইনগত ভিত্তি থাকতে হবে। সেই ভিত্তির ওপরেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এনসিপি এই অবস্থান মৌখিকভাবে জানিয়েছে, প্রয়োজনে তা লিখিত আকারেও জমা দেবে।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। তবে কমিশনের প্রস্তাবনায় র্যাংক চয়েস পদ্ধতি ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সরাসরি যাওয়ার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। বিচার বিভাগকে বাইরে রাখার ব্যাপারেও ঐকমত্য রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরানোর ব্যাপারে সবাই একমত। তবে সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে গণপরিষদ নির্বাচন সর্বোত্তম। আর জুলাই সনদের যেন দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় পতিত না হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
খসড়া ‘অসম্পূর্ণ ও বিপজ্জনক’ জামায়াত জুলাই সনদের খসড়াকে ‘অসম্পূর্ণ ও বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আজ তারা বলছে এটা নমুনামাত্র, ভুল হয়েছে। যদি সেটাই হয়, তাহলে মন্তব্যের দরকার নেই। আর যদি সেটাই মূল খসড়া হয়, তাহলে এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
তাহের জানান, জামায়াত নিজস্ব একটি বিকল্প খসড়া সনদ তৈরি করে কমিশনে জমা দেবে। সেই খসড়ায় আইনি কাঠামোর দুটি বিকল্প থাকবেÑ প্রথমটি অধ্যাদেশ জারি করে পরে সংসদে অনুমোদন। আর দ্বিতীয়টি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন।
আমরা যেকোনো একটি পদ্ধতিতে এই কাঠামোকে বৈধতা দিতে চাই বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, না হলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে যাবে।গভীর মতবিরোধের কেন্দ্রবিন্দু তত্ত্বাবধায়ক সরকার
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একমত হলেও, তার গঠন ও কার্যপ্রণালি নিয়ে মতপার্থক্য প্রকট। জামায়াতের প্রস্তাব অনুযায়ী, পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটিÑ প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধী দলের ডেপুটি স্পিকার এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধিÑ কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান নির্বাচন করবেন।
যদি ঐকমত্যে না পৌঁছানো যায়, তাহলে তিন ধাপে ভোট হবে। প্রথমটি সর্বসম্মতি, দ্বিতীয়টি ওয়ান চয়েস ভোট এবং শেষেরটি র্যাঙ্ক চয়েস ভোটিং পদ্ধতি।
এই কমিটিতে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের একজন করে বিচারপতিকে যুক্ত করে মোট সাতজন ভোটারের একটি কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে ও পক্ষপাত এড়ানো যায়।
তাহের বলেন, বিচারপতি দুজন যুক্ত করা হয়েছে যেন কোনো পক্ষ এককভাবে সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে না পারে এবং হর্স ট্রেডিংয়ের সুযোগ না থাকে।
তবে বিএনপি এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে বলেছে, যদি ঐকমত্য না হয়, তাহলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো উচিত।
জামায়াতসহ অনেক দলের মত হচ্ছে, সংসদে পাঠালে তা আর সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না। তাদের মতে, ৩০টি দলের অংশগ্রহণে গঠিত কমিশনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত মঞ্চ।
বিএনপির দ্বৈত বার্তায় সমালোচনার মাঝেও ইতিবাচক এদিকে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা খুব খুশি হই যখন পত্রিকায় একটা পজিটিভ নিউজ দেখি। আজকেই খবরের কাগজে দেখলাম, বোধহয় ১২টা মৌলিক বিষয় পরিবর্তনে সব দল এক হয়েছে। দিস ইজ এ পজিটিভ স্টেপ।
তিনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে তার টিমকে নিয়ে অন্তত ওই জায়গাটায় আসার চেষ্টা করেছেন। তবে দলের পক্ষ থেকে এখনো ‘জুলাই সনদ’ বা কেয়ারটেকার কাঠামো নিয়ে চূড়ান্ত অবস্থান স্পষ্ট করা হয়নি।
কমিশনের সময় সংকট ও আশাবাদ
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আজকের দিনসহ (গতকাল মঙ্গলবার) হাতে মাত্র তিন দিন সময় আছে। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে সনদ চূড়ান্ত করতে হবে।
তিনি জানান, প্রাথমিক খসড়া দলগুলোর হাতে পৌঁছে গেছে এবং বুধবার পর্যন্ত তাদের মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করা হবে। পরে সব মতামত সমন্বয় করে একটি চূড়ান্ত রূপরেখা প্রকাশ করা হবে।
৩০টি দলের অংশগ্রহণ, ঐকমত্য অনুপস্থিত মঙ্গলবারের আলোচনায় অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল। তবে এত সংখ্যক দলের উপস্থিতি সত্ত্বেও একটি কার্যকর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যা পুরো উদ্যোগটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
ঐকমত্য না হয়ে জাতীয় বিভাজনের দিকেই যাচ্ছে কি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার যে মহৎ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা এখন নীতিগত মতপার্থক্য, আইনি অনিশ্চয়তা এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত। একদিকে সময়ের চাপ, অন্যদিকে পদ্ধতিগত অনৈক্যÑ এই দুইয়ের সংমিশ্রণে পুরো প্রক্রিয়া একটি অস্থির ও বিভক্ত পরিণতির দিকে যাচ্ছে।
তাদের মতে, আইনি কাঠামো ছাড়া কোনো ঐকমত্য কার্যকর নয়। দলগুলো যদি সংবিধান সংশোধন, গণভোট কিংবা অধ্যাদেশের মতো কাঠামোগত বিষয় নিয়ে একমত হতে না পারে, তাহলে জুলাই সনদ ‘জাতীয় ঐকমত্য’ নয়, বরং ‘জাতীয় বিভাজনের’ দলিল হয়ে উঠবে।
একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেন, ঐকমত্য চাপিয়ে দেওয়া যায় না, তা গড়ে তুলতে হয়। আর সেটা করতে গেলে সময়, স্বচ্ছতা ও আস্থার প্রয়োজন। এই তিনটিরই এখন ঘাটতি স্পষ্ট। এই প্রেক্ষাপটে, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে একটি কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য চূড়ান্ত সনদ প্রকাশ সম্ভব হবে কি নাÑ সেটিই এখন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন।