ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

আতঙ্কের নাম রাউজান, এক বছরে নিহত ১৫

মো. সাহাব উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৫, ০১:০৫ এএম

দিনে দিনে আতঙ্কের ভয়ঙ্কর এক নাম হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের রাউজান। গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপির প্রভাবশালী দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বারবার কেঁপে উঠেছে পাহাড়ঘেরা এই জনপদ।

দিনে-রাতে মুহুর্মুহু গলির শব্দ, মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ঝনঝনানি আর রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াই শান্ত হতে দিচ্ছে না রাউজানকে। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে সেখানে। এতে নিহতের সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে অন্তত ১০টি হত্যাকা- ঘটেছে রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ের কারণে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে সবুজ-শ্যামল এই পৌরসভা। প্রশাসন বারবার অভিযান চালাচ্ছে, বদল হয়েছে থানার ওসিও। তাতেও থামানো যাচ্ছে না কোন্দল।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর থেকে রাউজানে শুরু হয় রক্তের হোলিখেলা। প্রথম হত্যাকা- ঘটে ২৮ আগস্ট। দিন-দুপুরে শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল মান্নানকে পিটিয়ে হত্যা করে দুষ্কৃতকারীরা। ১ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়ি থেকে মো. ইউসুফ মিয়া নামে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। রাতের আঁধারে তাকেও হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে। ১১ নভেম্বর নিখোঁজের ৩ দিনের মাথায় রক্তাক্ত অবস্থায় হাফেজ মাওলানা আবু তাহের নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। রাজনৈতিক বিরোধের জেরে এই হত্যাকা- হয় বলে জানান স্থানীয়রা।

চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি উপজেলার নোয়াপাড়া এলাকায় গ্রামের বাড়িতে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন নগরীর খাতুনগঞ্জের আড়তদার মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি শহর থেকে মোটরসাইকেলে বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাকে স্থানীয় যুবদল সন্ত্রাসীরা খুন করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

১৯ ফেব্রুয়ারি মুহাম্মদ হাসান নামে এক যুবলীগ কর্মীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা। তাকেও রাজনৈতিক বিরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। ১৫ মার্চ ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের মারধর ও ছুরিকাঘাতে খুন হন কমর উদ্দিন জিতু নামে এক যুবদল কর্মী।

২১ মার্চ পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হোয়ারাপাড়া এলাকার মোবারক খালের পূর্ব পাশে খোলা জমি থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মো. রুবেল নামে এক তরুণের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গরুচোর সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। ১৯ এপ্রিল রাতে খুন হন যুবদল কর্মী মানিক আবদুল্লাহ। ১৫ জন মুখোশধারী সন্ত্রাসী এসে ভাত খাওয়া অবস্থায় মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। ২২ এপ্রিল রাউজান উপজেলা সদরের কাছে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে গাজিপাড়া গ্রামে খুন হন ইব্রাহিম নামের অপর এক যুবদল কর্মী।

রাজনৈতিক খুনের পাশাপাশি অরাজনৈতিক হত্যাকা-ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। নিখোঁজের ৪ দিন পর উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মইশকরম এলাকা থেকে পুলিশ অর্ধগলিত একটি লাশ উদ্ধার করে। এই লাশটি ছিল আজম খানের। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে রাউজান থানায় হত্যা মামলা করেন নিহতের স্ত্রী লাকী আকতার।

৪ এপ্রিল পারিবারিক দ্বন্দ্বে সহোদর দুই ছোট ভাইয়ের ধারালো অস্ত্র ও রডের আঘাতে খুন হন বড় ভাই প্রকৌশলী মো. নূর আলম বকুল। ১৭ এপ্রিল রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের মাহামুনি দিঘী থেকে মো. জাফর নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত জাফর রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামের মো. ইব্রাহিমের ছেলে। তাকে হত্যা করে দিঘীর পানিতে লাশ ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ নিহতের ভাই সাইফুল ইসলামের।

২৫ জুন উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের যুগীপাড়ার কর্ণফুলী নদীর পাড়ের বোট ঘাটা এলাকা থেকে বালু দিয়ে মস্তক এবং গাছের পাতা দিয়ে শরীর ঢাকা অবস্থায় রুপন নাথ নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩ জুলাই ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে মারামারিতে লিপ্ত হয় এলাকার কিশোরদের দুটি পক্ষ। তা থামাতে গিয়ে ঘুষিতে আলমগীর নামে এক যুবদল নেতা নিহত হন। তিনি উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

গত মঙ্গলবার বিকেলে আবারও রক্ত ঝরল রাউজান পৌরসভার সত্তারঘাটে। উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারের গাড়িবহরে হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় আহত হন অন্তত ৩০ জন। আহত অবস্থায় খোন্দকারকে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সংঘর্ষের পর উভয় পক্ষ আগের নিয়মে পরস্পরকে দোষারোপ করতে দেখা গেছে।

তবে এই সংঘর্ষের পর কেন্দ্রীয়ভাবে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে বিএনপি। ভেঙে দেওয়া হয়েছে উত্তর জেলা আহ্বায়ক কমিটি। স্থগিত করা হয়েছে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর সব পদ। দলীয় সূত্র বলছে, রক্তের রাজনীতিতে চরম অস্বস্তিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বললেন, ‘দুই পক্ষের বিরোধের কারণে বারবার সংঘর্ষ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা দিনরাত কাজ করছি। এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে উচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এলাকায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে আমরা (আইনশৃঙ্খলার বাহিনী) সহজে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারব।’