২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে প্রণীত ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ খসড়া পাঠানো হয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। ২৬ দফার এই খসড়া ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশে একটি নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেখানে সুশাসন, মানবাধিকার, আইনের শাসন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলমান সংলাপে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ। তিনি জানান, আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব রাজনৈতিক দলের কাছে একটি ‘সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য’ খসড়া সনদ হস্তান্তরের প্রস্তুতি চলছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় দফার ২২তম বৈঠকে অংশগ্রহণের আগে তিনি এ কথা জানান।
জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের মূল প্রতিশ্রুতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে ‘উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি’ প্রদান করা। এতে বলা হয়েছে, ‘বিশেষত, সংবিধানের প্রস্তাবনায় এর উল্লেখ থাকবে এবং তপশিলে এই ঘোষণাপত্র সংযুক্ত থাকবে।’ খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে, ঘোষণাপত্রটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা যায়, সংস্কার প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ খসড়া গত মঙ্গলবার দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে এটি ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তিতে আগামী ৫ আগস্ট প্রকাশ করা হবে।
খসড়া ঘোষণাপত্রে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও অভিযোগের তালিকা: ঘোষণাপত্রের শুরুতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে রয়েছে ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান। সবকিছুকে একটি যৌক্তিক রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
খসড়ায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বাকশালের মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর সিপাহি-জনতার বিপ্লব। ১/১১ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ষড়যন্ত্র। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রহসনের নির্বাচন। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, মানবাধিকার লঙ্ঘন। ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার, পরিবেশ বিনাশ এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম ও ছাত্র আন্দোলন।
ঘোষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকার জনগণের ওপর চরম দমন-পীড়ন চালিয়েছে এবং সরকারপতনের আন্দোলনে ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশে একটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, যার চূড়ান্ত পর্যায়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর জনগণের দাবিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্পন্ন হয়েছে বলে খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া : ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ খসড়া হস্তান্তরের পর একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা খসড়া হাতে পেয়েছি। দলীয় ফোরামে দ্রুততম সময়ে পর্যালোচনা করে আমাদের মতামত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জানিয়ে দেব।’
জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের পাঁচ পৃষ্ঠার খসড়া আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তরফ থেকে। আমরা দ্রুত মতামত জানিয়ে দেব।’
এর আগে এই ঘোষণাপত্রের প্রাথমিক খসড়া জুলাই মাসের প্রথমার্ধে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। এবার চূড়ান্ত খসড়ার ওপর দলগুলোর পূর্ণাঙ্গ মতামত নেওয়া হচ্ছে।
খসড়া পাওয়ার তথ্য দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘সরকার যে খসড়া দিয়েছে, সেটা পরিণত নয়। সরকারকে আমাদের পক্ষ থেকে একটি পরিণত খসড়া দিয়েছি এবং আলোচনার মধ্যেই রয়েছি, কিন্তু এখনো পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি চোখে পড়ছে না।’
তিনি বলেন, সরকার ‘৩৬ জুলাইয়ের’ (৫ অগাস্ট) মধ্যে এ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে না পারলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তারাই তা ঘোষণা করবেন।
ঘোষণাপত্র প্রকাশের পটভূমি ও সময়সীমা: গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ৩১ ডিসেম্বর ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচিও দেওয়া হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ওই সময় বলেছিলেন, এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নাৎসি বাহিনীর মতো অপ্রাসঙ্গিক এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের ‘কবর’ রচনা করা হবে। প্রথমে সরকারের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও পরে সরকারের তরফ থেকে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার আলোচনার পাশাপাশি চলতে থাকে ঘোষণাপত্র ও জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের কাজ।