ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। আগস্ট মাসের ২৫ দিনেই মশাবাহী রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৫ জনের এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে সাত হাজার। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১১৮ জনের। যা মৃত্যুর দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও চলতি বছর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্ত রোগী ছিল গত জুলাই মাসে ১০ হাজার ৬৮৪ জন। তবে যে হারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আগস্টের বাকি ৫ দিনে এ সংখ্যা ছাড়িয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মাসের শুরুতে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। মাসের ১ তারিখে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩৮ জন। কিন্তু এক লাফে ৬ তারিখে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২৮ জনে। এরপর আর এই সংখ্যা নিচে নামেনি। ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। প্রথম দিকে রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল কম। কিন্তু গত ৫ দিনের ব্যবধানে মারণঘাতী রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেছে ১৩ জনের। গত ২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু প্রাণ কেড়ে নেয় ৪ জনের। এরপর ২৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার আরও ৫ জনের মৃত্যু হয় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। ২৪ আগস্ট অর্থাৎ রোববার ১ জন এবং গতকাল ৩ জনের মৃত্যু হয়। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগস্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
ডেঙ্গু প্রতিরোধবিষয়ক এক সভায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও স্বীকার করেছে, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত রোববার আয়োজিত এ সভায় জানানো হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার এখন বাংলাদেশে, আর বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহারের দিক থেকে রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। ওই সভায় বলা হয়, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুর প্রকোপের জন্য অত্যন্ত ঝুঁঁকিপূর্ণ। আগস্টে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়বে এবং হাসপাতালগুলোয় ভর্তির চাপ বাড়তে পারে। বিগত বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে এ প্রকোপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। তবে অক্টোবরে বর্ষা শেষ হলে সংক্রমণ কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে সিটি করপোরেশনগুলো যদি কাজই করে থাকে, তাহলে রোগী বাড়ছে কেন? মৃত্যু হচ্ছে কেন? কোথাও তো ঝামেলা আছে। সেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেওয়া খুব জরুরি। এডিস মশা নিয়ে গবেষণার জায়গায় একটা দুর্বলতা হচ্ছে, আমাদের দেশে মেডিকেল এন্টোমলজিস্ট আসলেই নেই। যারা কাজ করেন, তারা হয় প্রাণিবিদ্যা অথবা কৃষি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। ২০১৯ সালে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগ তেমন ছিল না। তারপরে আমরা দেখেছি কুষ্টিয়া, যশোর, মেহেরপুর, বরিশালের মতো কয়েকটা জেলায় ছিল। এ বছর কোনো জেলা বাদ নেই। আমরা শহরাঞ্চলে এডিস এজিপ্টি নিয়ে কথা বলি, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এডিস এলবোপিকটাস বেশি থাকে, সেটা নিয়ে আলোচনা হয় না। ঢাকার বাইরে যেসব জায়গায় সার্ভে হয়েছে, সবখানেই এলবোপিকটাস বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। এর চরিত্র এজিপ্টি থেকে একেবারেই আলাদা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্তের জেলা হচ্ছে বরিশাল। জেলাটিতে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬২৯ জনে। এরপরেই আক্রান্তের দিক দিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী রয়েছে চট্টগ্রামে। বিভাগীয় শহরটিতে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত আক্রান্তের ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ২৭৯ জন। রাজধানী ঢাকার আশপাশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৫৯ জন। আর শহরের দুই সিটি অর্থাৎ ঢাকা উত্তর সিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৬৪৬ জন আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ২০৮ জন। এরপরেই আক্রান্তের দিক থেকে সর্বোচ্চ রোগী রয়েছে রাজশাহীতে। উত্তরবঙ্গের এই বিভাগে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ১৬৮ জন। রংপুরে ১৯২ জন, ময়মনসিংহে ৪৯৫ জন এবং সিলেটে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৯ জন।
মাস হিসেবে আক্রান্তের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল ১ হাজার ১৬১ জন। তবে ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিলে তুলনামূলক কম যথাক্রমেÑ ৩৭৪ জন, ৩৩৬ জন এবং ৭০১ জন আক্রান্ত হন। মে মাসে আবারও আক্রান্তের সংখ্যা হাজারের ঘর ছাড়ায়। ওই মাসে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৭৩ জন। জুন মাসে আক্রান্ত হয় ৫ হাজার ৯৫১ জন। জুলাইয়ে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ৬৮৪ জন। আর চলতি আগস্টের ২৫ তারিখেÑ অর্থাৎ গত রোববার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬৪ জন।
এখনই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সাধারণত জুন-জুলাই মাসকে বলা হয় ডেঙ্গুর প্রজনন মৌসুম। তবে বর্ষাকাল আরেকটু বিস্তৃত হলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও থাকতে পারে এর প্রভাব। কিন্তু চলতি বছরের প্রায় পুরোটা সময় করোনাভাইরাসের দাপটের সঙ্গে সঙ্গে সমানতালে ছিল ডেঙ্গুর দৌরাত্ম্য। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা। হাসপাতালে ভর্তিদের মধ্যে কেউ কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও বেশির ভাগই কাতরাচ্ছেন জ্বরে। সিটি করপোরেশন লোক দেখানো পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করলেও কার্যত মশা নিয়ন্ত্রণ কিছুই হচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। আর সিটি করপোরেশন বলছে, নগরবাসীর অসচেতনতার কারণেই অনেক চেষ্টায়ও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধের একমাত্র উপায় এডিস মশা নিধন। শত্রু যেহেতু আমরা চিনি, তাহলে প্রতিরোধব্যবস্থা নিতে কার্যকর উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে না, তা বোধগম্য হচ্ছে না। এডিস মশা নালা-নর্দমার নোংরা পানিতে জন্মায় না, বরং জন্মায় মানুষের ঘরের ভেতরে ও আশপাশে জমে থাকা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানিতে। ছাদে ও বারান্দায় জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে, গাছের টব, ডাবের খোসা ইত্যাদি আধারে জমে থাকা পানিতে। বর্ষাকালে প্রায়ই থেমে থেমে বৃষ্টি হয় বলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটে এবং এটাকেই ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম বলা হয়। প্রাকৃতিকভাবে জুন থেকেই শুরু হয় ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজনন ঋতু। এখন সম্মিলিতভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে। কেউ কাউকে দোষারোপ না করে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে এটি প্রতিরোধ করতে হবে।
চলতি মাসে ডেঙ্গুর এই সংক্রমণ পরিস্থিতি শঙ্কা জাগাচ্ছে উল্লেখ করে অপর বিশেষজ্ঞ ডা. সালেহ মাহমুদ তুষার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা বরাবরই বলে আসছি ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি। যা বছর শুরুর আগেই করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আমরা ২০১৯-এর ডেঙ্গু মহামারির পরে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি এখন শুধু নগরের রোগ নয়। এটি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ায় এটি এখন সারা বছরই থাকছে। এ কারণেই কিন্তু কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের একট জায়গায় প্রায় ৯শর বেশি কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশনগুলো প্রতিদিনই মশা প্রতিরোধে নানা ধররের লম্ফঝম্প করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই চোখে পড়ে না। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নিয়মিত মশা নিধন অভিযান পরিচালনা করা।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে দাবি করেছেন ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ফুটপাত দখল করে বসা বাজার বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে কঠিন করে তুলছে, যা মশার প্রজননে সহায়ক। আমরা সারা রাত শহরের আবর্জনা পরিষ্কার করি; কিন্তু দুপুরের মধ্যেই আবার শহর নোংরা হয়ে যায়। ডেঙ্গু মোকাবিলা শুধু সিটি করপোরেশন বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একক দায়িত্ব নয়, বরং এ জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
এর আগে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়, পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।