রবিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২৫, ১১:৪২ পিএম

গণঅভ্যুত্থানে গুলিতে  নিহত ১৩২ শিশু

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২৫, ১১:৪২ পিএম

গণঅভ্যুত্থানে গুলিতে  নিহত ১৩২ শিশু

ছয় বছর বয়সি ছোট্ট জাবির ইব্রাহিম। উত্তরার দক্ষিণখানে পরিবারের সঙ্গে বাস করত। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় স্থানীয় স্কুলে নার্সারির ছাত্র জাবির ইব্রাহিমের কণ্ঠেও ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। শিশুটির পরিবারও সেদিন সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছিল ছাত্র-জনতার মিছিলে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেষ বিকেলে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে আচমকা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। হুলস্থুল পরিস্থিতির মধ্যে দৌঁড়াতে থাকে জনতা। এ সময় বাবার কাঁধে থাকা ছোট্ট জাবিরের পায়ে লাগে গুলি। ছেলেকে বাঁচাতে বাবা কবির হোসেন ভূঁইয়া হাসপাতালে দৌড়ালেও শেষরক্ষা হয়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পথেই নিথর হয়ে যায় শিশুটির দেহ। বাবার হাতেই শহীদ হয় ছোট্ট জাবির।

শিশুটির মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, গোটা জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তৈরি করে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন শিশুটির বড় ভাই মাহতাব ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বোন নেহা। বাবা কবির হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলেকে উৎসর্গ করেছি দেশের জন্য। যদি এই রক্তে মানুষের মুক্তি আসে, তবে আমাদের আত্মত্যাগ সার্থক।’ জাবিরের পরিবার দাবি করে, সে-ই বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানে সর্বকনিষ্ঠ শহীদ। শুধু জাবিরই নয়, গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছে অন্তত ১৩২ শিশু। 

জানা গেছে, ওই দিন জাবিরের বাবা ও তিন চাচার পরিবারসহ সবাই ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। সঙ্গে ছিল জাবিরও। উত্তরা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তর গেটে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় শিশু জাবির। 

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছড়িয়ে পরে রাজধানী থেকে জেলা শহর, মহল্লা থেকে বাড়ির ছাদ পর্যন্ত। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নেয় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের প্রতিরোধে। আন্দোলনে যেমন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পেশাজীবী, শ্রমজীবী মানুষ, তেমনি ছিলেন শিশুরাওÑ তাদের কেউ পরিবারের সঙ্গে অংশ নিয়েছে, কেউবা নিজের স্কুলব্যাগ নামিয়ে এসেছে রাস্তায়। সেদিন ওপর থেকে র‌্যাবের হেলিকপ্টারেও গুলি ছোড়ে র‌্যাব সদস্যরা। এতে ছাদে থাকা, বাসার জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা অনেকের শরীরেও বিদ্ধ হয় ঘাতকের গুলি। 

জাবিরের মতোই আরেক শিশু রিয়া গোপও প্রাণ হারায় অনিয়ন্ত্রিত গুলির শিকার হয়ে। নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটিতে চারতলা একটি বাড়ির উপরের তলায় বাস করত ছয় বছর সাড়ে ছয় মাস বয়সি রিয়া। সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর ছাদে খেলতে গিয়েছিল সে। কিছুক্ষণ পরই রাস্তায় শুরু হয় সংঘর্ষ। রাস্তায় হট্টগোল শুনে বাবা দীপক গোপ দৌঁড়ে যান মেয়েকে আনতে। কোলে নেওয়ার মুহূর্তেই একটি গুলি এসে আঘাত হানে রিয়ার মাথায়। মেয়ের নিথর দেহ ঢলে পড়ে বাবার কোলে। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, মাথায় গানশট ইনজুরিই রিয়ার মৃত্যু ঘটিয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষার পর দীপক ও বিউটি দম্পতির ঘর আলো করে এসেছিল রিয়া। তার মৃত্যুর পর শুধু একটি সন্তান নয়, একটি ভবিষ্যতের মৃত্যু হয়। মেয়ের নিথর মুখ যখন মর্গ থেকে বের করে দেওয়া হয় পরিবারের কাছে, কান্নায় ভেঙে পড়ে সবাই। রিয়ার বাবা-মা যেন নিঃশব্দ যন্ত্রণায় পাথর হয়ে যান। সেই একটি গুলিতে শেষ হয়ে যায় তাদের জীবনের সব আলো।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগেও একই রকম এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে ১৯ জুলাই। বিকেল ৪টার দিকে সাত বছর বয়সি শিশু আবদুল আহাদ বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল তার মা-বাবার মাঝে। নিচে সংঘর্ষ চলছিল পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের। হঠাৎ সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাবা ভেবেছিলেন, মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। কিন্তু তাকে তুলতে গিয়ে দেখেন, সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। 

সেখানে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। চিকিৎসকেরা জানান, গুলি মাথার মধ্যে রয়ে গেছে। অবস্থান বোঝার জন্য সিটিস্ক্যান প্রয়োজন, কিন্তু এতে জীবনহানির আশঙ্কা আরও বাড়ে। সেদিন রাত সাড়ে ৮টায় আইসিইউতেই তার মৃত্যু ঘটে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিজেদের গ্রামে আগে কোনো পারিবারিক কবরস্থান ছিল নাÑ আহাদের দাফনের মধ্য দিয়েই সেই কবরস্থানের যাত্রা শুরু হয়।

এই আন্দোলনে আরেক শহীদ নাঈমা সুলতানা। বয়স ১৫। ছবি আঁকতে ভালোবাসত। সেদিনও বাসায় বসে আঁকছিল এবং মাকে বলছিল, সে পিৎজা বানাবে। হঠাৎ সে বারান্দায় যায় শুকনা কাপড় আনতে। মাও যাচ্ছিলেন তার পেছনে। বারান্দার দরজা খোলার মুহূর্তে একটি গুলি এসে ঢুকে পড়ে নাঈমার মাথায়। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের চারতলার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। তার মা আইনুন নাহার সেই ঘটনার স্মৃতি স্মরণ করে আজও কেঁদে ওঠেনÑ ‘এক মুহূর্তেই আমার মেয়ে চলে গেল হাতের মধ্যেই।’

শুধু শিশু নয়, কিশোররাও আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল। ১৭ বছর বয়সি শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আহনাফ বলত, সে বড় হয়ে এমন কিছু করবে যাতে তার পরিবার গর্ব করতে পারে। সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই সে চলে যায়। তার শ্রেণিকক্ষে আজ শুধু শূন্য বেঞ্চ আর কিছু ফুল পড়ে থাকে। শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের ক্লাস রুমের শূন্য আসনে ফুল রেখে শিক্ষকরা শ্রদ্ধা জানায়।

আরও এক কিশোর শহীদ হয় একই দিনে। ১৬ বছর বয়সি আবদুল্লাহ আল মাহিন, উত্তরা আজমপুরে রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের সামনে ছররা গুলিতে মারা যায়।

আন্দোলনে সে ছিল সক্রিয়, সাহসী, অদম্য। অথচ সে ছিল জামিল হোসেন ও সামিরা জাহান দম্পতির একমাত্র সন্তান।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই গণঅভ্যুত্থানে ১৩২ জন শিশু ও কিশোর এবং ১১ জন নারী শহিদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার জন, যাদের মধ্যে ৫০০ জন চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

একটি রাষ্ট্রের ভেতরে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রের মুখে পড়ে যায় শিশুরা, তখন সেই রাষ্ট্রের আত্মা যেন প্রশ্নের মুখে পড়ে। জাবির, রিয়া, আহাদ, নাঈমা, আহনাফ, মাহিনÑ এরা কেউ রাজনীতি বোঝার বয়সে ছিল না, কিন্তু ন্যায়বিচারের স্পর্শ তারা পেত। তারা শুধু মানুষ হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। তাদের শরীরে যে গুলি লেগেছে, তা শুধু তাদের রক্ত বইয়ে দেয়নি, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আমাদের মানবিকতা, আমাদের নৈতিকতা, আমাদের রাষ্ট্রীয় বিবেক।

এই মৃত্যু সংখ্যা নয় এগুলো একেকটি পরিবারের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন। এই শিশুরা আজ আর জীবিত নেই, কিন্তু তারা ছড়িয়ে গেছে বাংলার বাতাসে, মানুষের প্রতিবাদের স্লোগানে এবং ইতিহাসের পাতায়Ñ যেখানে তারা লেখা থাকবে ‘শিশু শহিদ’ হিসেবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!