- অনুমতির জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারেনি, এ অভিযোগ সত্য নয় : বেবিচক চেয়ারম্যান
- অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত আমদানি কুরিয়ার সেকশন থেকে
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের ভয়াবহ আগুন নেভাতে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আগুন নির্বাপণের কাজ শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, রাস্তার দিক থেকে আগুনে পানি ছিটানো শুরু করতে দেরি হয় প্রায় ২৫ মিনিট। অগ্নিকা-ের সূত্রপাত আমদানি কুরিয়ার সেকশন থেকে ঘটেছে বলে দাবি কৃর্তৃপক্ষের। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে ইমপোর্ট কুরিয়ার সেকশন থেকে। আগুন লাগার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে অনুমতির কারণে তারা কাজ করতে পারেনি এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন বেবিচক চেয়ারম্যান।
আগুনের বিষয়ে ঢাকা বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের কুরিয়ার ইউনিট ভবনের রাস্তার ঠিক উল্টো দিকের সিগারেট বিক্রেতা তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ২টা ২৫ মিনিটে ধোঁয়া দেখা যায়। তিনি বলেন, চুলা জ্বললে যেমন ধোঁয়া দেখা যায়, তেমন ধোঁয়া দেখি। এরপরই একটু বেশি ধোঁয়া দেখা যায়। ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের আওয়াজও শুনি। কিন্তু ১০ মিনিট পর দেখি অন্য একটা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পানির পাইপ সেট না করে এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে।
একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী জানান, শনিবার আগুন লাগার সময় উপস্থিত ছিলেন কার্গো ভিলেজে। তিনি জানান, আট নম্বর গেট দিয়ে একটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বের হয়ে আসে কুরিয়ার ভবনের সামনের রাস্তায়। চেষ্টা সত্ত্বেও আগুনে পানি দিতে অনেক সময় নষ্ট হয়। তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়ার ১০ মিনিট পর দেখি আট নম্বর গেট দিয়ে একটি গাড়ি বের হচ্ছে। হয়তো তারা আগেই ঢুকেছিল, আমি হয়তো দেখি নাই। তার গেট খোলা চেষ্টা করেও পারিনি। পরে কুরিয়ারের দিকে গেট ভেঙে সেদিক দিয়ে পানির পাইপ নেয়। পরে তিন নম্বর গেট ভেঙে পানির পাইপ নেওয়ার চেষ্টা করে।
আগুন যখন বাড়ছিল, তখন সেখানে উপস্থিত অনেকেই ফেসবুকে লাইভ করেন। এর দুটি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি হলুদ রঙের আগুন নেভানোর গাড়ি কুরিয়ার ভবনের সামনে আসতে দেখা যায়। তখন আকাশে ধোঁয়ার কুন্ডলি বাড়ছিল। গাড়িটিকে ভবনের একেবারে কাছে নেওয়ার জন্য একটি গেট খোলা হয়। কিন্তু গাড়ি প্রবেশ করানো যায়নি। এরপর গাড়িটিকে নেওয়া হয় বাম পাশে কার্গো ভিলেজের কাছে। কিন্তু পানি পাওয়া যাচ্ছিল না। ভিডিওতে একজনকে বারবার বলতে শোনা যায়, মেশিন নাই, পানি নাই। ভিডিওজুড়ে শোনা যায় শুধু আক্ষেপ আর আহাজারি। বাড়ছিল আগুন, পুড়ছিল পণ্য। অনেক চেষ্টার পর শুরু হয় পানি ছিটানো। ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে ১২ মিনিট।
প্রত্যক্ষদর্শী সিঅ্যান্ডএফ কর্মী মাহবুবুর রহমান জানান, তিনি দেড়টা পর্যন্ত কাজ করেন কার্গো ভিলেজের কুরিয়ার ইউনিটের ভেতরে। এরপর যান কাস্টমস হাউসে। আগুন লাগার খবর শুনে ছুটে যান সেখানে। এরপর ভিডিও করেন। তিনি যখন ভিডিও রেকর্ড করেন, তখন মোবাইলে সময় ছিল ২টা ৩৮ মিনিটি। তার ভিডিতেও হলুদ রঙের ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটি দেখা যায়।
সিগারেট বিক্রেতা তরিকুল ধোঁয়া দেখেন ২টা ২৫ মিনিটে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, তারা আগুনের খবর পান ২টা ৩০ মিনিটে। আর মাহবুবের ভিডিওতে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকছে ২টা ৩৯ মিনিটে। আর পানি ছিটানো শুরু হয় তারও ১২ মিনিট পর। অর্থাৎ দেরিতে কাজ শুরুর যে অভিযোগ প্রত্যক্ষদর্শীরা করেছেন তা সঠিক।
গতকাল মঙ্গলবার বেবিচক সদর দপ্তরে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের সূত্রপাত ইমপোর্ট কুরিয়ার সেকশন থেকে হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো নিশ্চিত নই, তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আগুনের সূত্রপাত ইমপোর্ট কুরিয়ার সেকশন থেকেই হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তদন্ত শেষ হলে আগুনের প্রকৃত কারণ নিশ্চিতভাবে জানা যাবে।’
তিনি আরও জানান, আগুন লাগার সময় ১৫টি ফ্লাইটকে বিকল্প রুটে পাঠানো হয়েছিল। বিমান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ থাকায় যাত্রীরা কিছুটা ভোগান্তিতে পড়েন। তবে সব যাত্রীকে পরদিন বিকেল ৪টার মধ্যে তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে পাঠানো সম্ভব হয়েছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আগুনের উৎস ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল এভিয়েশন, পুলিশের ক্রাইম সিন ইউনিট ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা যৌথভাবে তদন্ত করছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেই বিস্তারিত জানানো হবে।’ বেবিচকের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘ঘটনাটি আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। ভবিষ্যতে কার্গো এলাকায় অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা হবে।’
বেবিচকের অনুমতি না পাওয়ায় ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের কাজ করতে দেরি হয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, আমি তদন্ত করে দেখেছি, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, কিন্তু কেউ বলেনি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে। তারপর কোনো কর্তৃপক্ষ যদি এ অভিযোগ করে, তাহলে আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। এ অভিযোগ যারা করছেন, সেটা সত্যি নয়।
ইমপোর্ট কার্গো সেকশনের সামনে খোলা আকাশের নিচে থাকা মালামালের কারণে ফায়ার সার্ভিস দ্রুত সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কোনো পক্ষকে দোষ দিতে যাব না। ওই ভবনের ভেতরে যে কার্যক্রমের দায়িত্ব বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, কাস্টমস, সিআন্ডএফ এজেন্ট ও কুরিয়ার এজেন্টদের। কার্গো সেকশনের সামনে এপ্রোনে যে মালামাল স্তূপ হয়ে থাকে সেটা ২১ দিনের মধ্যে ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ার কথা। যদি এর মধ্যে ক্লিয়ার না হয়, তাহলে এ তিন কর্তৃপক্ষ মিলে সেগুলো ক্লিয়ার করে। মালপত্র জমে থাকার দায়-দায়িত্ব তাদের। এ মালপত্রগুলো না সরানোর কারণে ফায়ার সার্ভিস যেতে দেরি হয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের আগুন নির্বাপণের জন্য চারটি গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে একটি নষ্ট। যেকোনো জিনিসের শতভাগ কাজ নাও করতে পারে। আমাদের যে তিনটি গাড়ি ছিল, সবই সেদিন ঘটনাস্থলে গেছে। নষ্ট গাড়িটি ঠিক করার প্রক্রিয়া চলমান।
অগ্নিকা-ের কারণে আন্তর্জাতিক মানদ-ে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর পিছিয়ে পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। দুর্ঘটনা ঘটবেই, আমাদের সেটা যাতে যত কম করা যায়।
অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা উন্নতির জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আপডেট করি। আমরা স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন