২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশের অর্থনীতি ছিল পুরোপুুরি টালমাটাল। প্রবৃদ্ধি কমছিল, মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে দ্বিগুণ অঙ্কে স্থায়ী ছিল, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছিল। ব্যাংকিং খাত ছিল সংকটে। বিশেষ করে জ্বালানি খাতে বৈদেশিক দেনা বেড়ে যাচ্ছিল, আর রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটা পিছিয়ে ছিল। গত ১৪ মাসে সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি যখন পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ঠিক তখন আগুনে পুরেছে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সম্প্রতি রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় শুধু হাজার কোটি টাকার পণ্যই নয়, বড় ধাক্কা লেগেছে দেশের সামগ্রিক বাণিজ্য কার্যক্রমের ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম ইপিজেডসহ একের পর এক পোশাক কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নাকি অন্য কোনো নাশকতার অংশ তা এখনই তদন্ত করা দরকার বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
অন্তর্বর্তী সরকার যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল, তা কোনোভাবেই স্বাভাবিক ছিল না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ২০২৪-এ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশে পৌঁছেছিল। এর আগের সাত মাসের মধ্যে ছয় মাসই এটি দুই অঙ্কের ঘরে ছিল এবং প্রায় তিন বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল, যা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। সরকারের কঠোর পদক্ষেপে গত প্রায় তিন বছরে প্রথমবার ২০২৫ সালের জুনে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামে। বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফ নির্দেশনার অপেক্ষা না করে একাধিকবার নীতি সুদহার বাড়ায় এবং বিনিময় হারকে আরও নমনীয়ভাবে সমন্বয় করতে দেয়। রাজস্ব নীতিও পরিবর্তিত হয়, উন্নয়ন ব্যয় সংকুচিত করা হয় এবং প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়। প্রকৃতপক্ষে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেড়েছে, যা দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে দিয়েছে। রপ্তানি ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়েছে, যদিও আগের বছর প্রায় ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। এই দুই প্রবৃদ্ধি মিলে মোট রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে যা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২৫ সালের জুনে দাঁড়ায় ৩২ বিলিয়ন ডলার এবং আইএমএফের বিপিএম৬ মানদ-ে ২৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতির সূচকগুলো মোটাদাগে একদিনে ঘুরে দাঁড়ায়নি। সময় নিয়েছে টানা ১৪ মাস। সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি যখন পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ঠিক তখন আগুনে পুরেছে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এরমধ্যে গত শনিবার রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা খরচ করে আমদানি করা শিল্পের মূল্যবান কাঁচামাল ব্যবসায়ীদের চোখের সামনেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়েছে জরুরি ‘কাগজপত্র’ও।
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ হলো আকাশপথে পণ্য পরিবহন, আমদানি ও রপ্তানির মূল কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকেই প্রতিদিন হাজার টন পণ্য দেশে আসে এবং বিদেশে যায়। তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ, ওষুধ, কৃষিপণ্য, ফুল ও উচ্চমূল্যের কুরিয়ার পার্সেল সব ধরনের পণ্য অস্থায়ীভাবে এই ভিলেজে সংরক্ষিত থাকে। আগুনে এসব পণ্যের বিপুল অংশ পুড়ে যাওয়ায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শত শত প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতার চালান সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা শুধু পণ্যের ক্ষতি নয়, পুরো সাপ্লাই চেইনই অচল হয়ে গেছে। কার্গো হ্যান্ডলিং বন্ধ থাকলে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য আটকে থাকবে। প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে, এ ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকার কম নয়। তবে এর চেয়েও গভীর ক্ষতি হচ্ছে দেশের রপ্তানি আস্থা ও লজিস্টিক সক্ষমতায়। তথ্যমতে, আগুনে পুড়ে যাওয়া আমদানি করা পণ্যের মধ্যে ৫৯ শতাংশ এসেছে চীন থেকে, ৯ দশমিক ৪ শতাংশ হংকং থেকে, ৫ দশমিক ৪ শতাংশ ভারত থেকে, ২ শতাংশ দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এবং বাকি অংশ অন্যান্য দেশ থেকে।
সবচেয়ে ঝুঁকিতে তৈরি পোশাক খাত
তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বিমানযোগে পাঠানো পোশাক সাধারণত অতি জরুরি অর্ডার যেখানে সময়ই সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) এবং এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘কার্গো ভিলেজের মতো সংবেদনশীল জায়গায় এমন দুর্ঘটনা অগ্রহণযোগ্য। আমরা বহুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছি পণ্যগুলো খোলা জায়গায় রাখা হয়, নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই।’ তার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক পোশাক কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা মিরপুর, চট্টগ্রাম ইপিজেড ও এখন বিমানবন্দর রপ্তানি উদ্যোক্তাদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। ‘এটা নিছক দুর্ঘটনা নাকি অন্য কোনো নাশকতার অংশ তা এখনই তদন্ত করা দরকার।
বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এ ঘটনায় শুধু পণ্য পুড়ে যাওয়াই নয়, কাঁচামাল না পাওয়ায় অর্ডার বাতিল, সময়মতো স্যাম্পল না পৌঁছানো, ডিসকাউন্টে বিক্রি এবং অতিরিক্ত ব্যয়ে পণ্য পাঠানোর মতো নানা ধরনের ক্ষতি হবে। তিনি আরও বলেন, একজন ছোট উদ্যোক্তার হয়তো কয়েক হাজার ডলারের পণ্য নষ্ট হয়েছে, কিন্তু এর কারণে কয়েক লাখ ডলারের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমন ক্ষতি অনেকের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।
পোশাক ও ওষুধশিল্পের উৎপাদন পেছাতে পারে ২ মাস
কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে পোশাক ও ওষুধশিল্প। এসব শিল্পের আমদানি করা কাঁচামাল ও উৎপাদন উপকরণ পুড়ে যাওয়ায় স্থানীয় শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদন কমপক্ষে দুই মাস পিছিয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, উৎপাদনকারীরা আরও আশঙ্কা করছেন ক্ষতির পরিমাণ ধ্বংস হওয়া কাঁচামালের মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর সবচেয়ে বড় উৎসব ক্রিসমাস আসন্ন। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত মৌসুমগুলোর একটি এটি। কিন্তু বিমানবন্দরে এই অগ্নিকা-ে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী উপকরণ পুড়ে যাওয়ায় এই মৌসুমের অর্ডারগুলো সময়মতো পাঠাতে না পারার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানকে এখন দ্রুত পণ্য পাঠানোর জন্য ব্যয়বহুল বিমানপথে চালান পাঠাতে হতে পারে। কেউ কেউ হয়তো দেরি পুষিয়ে নিতে ক্রেতাদের ছাড়ও দেবে। ফলে তাদের মুনাফা কমে যাবে। সবমিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণটা অনেক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একইভাবে, ওষুধশিল্পের কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ায় সেগুলো আবার আমদানি করতে হবে। এতে নতুন করে ব্যাংক ঋণ ও সরকারের অনুমোদনের প্রক্রিয়া পেরোতে সময় লাগবে। ফলে উৎপাদন বিলম্বিত হবে এবং সুদের কারণে খরচ আরও বাড়বে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী উপকরণ হারানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোর উৎপাদন অন্তত দুই মাস পিছিয়ে যাবে।
ক্ষতির বোঝা সাধারণ ভোক্তার ওপরও পড়বে
কার্গো ভিলেজের অগ্নিকা-ে আমদানিকারকরাও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সেখানে ছিল ওষুধশিল্পের কাঁচামাল, শিল্পযন্ত্রাংশ, মোবাইল ও ইলেকট্রনিক পণ্য, খাদ্য ও ফলমূলের চালান। এসব পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারা বিমা দাবি ছাড়া বিকল্প পথ পান না যা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে মাসের পর মাস। ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এই ক্ষতির বোঝা আমদানি ব্যয় ও বাজারমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ ভোক্তার ওপরও পড়বে। বিশেষ করে ওষুধ ও খাদ্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হলে অভ্যন্তরীণ বাজারে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
ক্ষতি হাজার কোটি, নাশকতা হলে বিমার টাকা মিলবে না
গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রাক্কলিত হিসাব দিয়ে বলেন, এই আগুনে রপ্তানিকারকদের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। হাতেম বলেন, রপ্তানিকারকদের মোট ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা এখনো কঠিন। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ৩২টি ওষুধ কোম্পানির আমদানি করা ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল আগুনে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে এই অগ্নিকা-ের ঘটনায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হলেও সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা বিমা দাবি পাবে কার্গো ভিলেজের মালিক ও পরিচালনাকারী সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। আইডিআরএর সূত্রমতে, অগ্নিকা-ের পর নাশকতার যে অভিযোগ উঠেছে, তা প্রমাণিত হলে বেবিচক এসবিসি থেকে বা বাংলাদেশি আমদানিকারকরা বিদেশি বিমা কোম্পানিগুলো থেকে কোনো বিমা দাবি সুবিধা পাবে না।
পুড়ে যাওয়া পণ্যে শুল্ক আদায় হলে ফেরত দেবে এনবিআর
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকা-ে যেসব পণ্যের শুল্ক পরিশোধ করা হয়েছিল, আইন অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তা ফেরত দিতে পারবে। তবে পণ্যের ক্ষতিপূরণের দায় এনবিআরের নয়, বরং তা বহন করতে হবে পণ্য সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা সংস্থাকে। এ ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, আইনের বিধিবিধান যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, যেসব পণ্যের শুল্ক পরিশোধের পর কিন্তু খালাসের আগে পুড়ে গেছে। এনবিআর সেই শুল্ক ও কর ফেরত দিতে বাধ্য। তবে যেসব পণ্যের শুল্কায়ন হয়নি, সেগুলোর ক্ষেত্রে কাস্টমের কিছু করার নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। ক্ষতিপূরণের দায় কার, তা স্পষ্ট করে এনবিআরের আরেক সাবেক সদস্য কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পণ্যের সংরক্ষণের দায়িত্ব বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বা দায়িত্বরত সংস্থার। এ জন্য তারা ভাড়াও নেয়। তাই ক্ষতিপূরণ জিম্মাদারকেই দিতে হবে, এটাই নিয়ম। তিনি আরও বলেন, কাস্টম সিস্টেমে শুল্ক কর পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গেই পণ্য খালাসের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। কাস্টম নিজে কোনো পণ্য সংরক্ষণ করে না।
টানা অগ্নিকাণ্ডে শিল্প খাতে অস্থিরতা
এর আগে ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে প্রিন্টিং ও কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ১৬ শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। তার দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেডে আগুনে কমপক্ষে ২০-২৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এখন আবার বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন সব মিলিয়ে শিল্প খাত যেন একের পর এক বিপর্যয়ে নিমজ্জিত। চট্টগ্রাম ইপিজেডের এক শিল্প উদ্যোক্তা বলেন, ‘প্রতি ঘণ্টা উৎপাদন বন্ধ থাকলে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়। মেশিন ও ফ্যাব্রিক পুড়ে গেলে পুনরুদ্ধারে মাস লেগে যায়। এর ফলে শুধু কারখানা নয়, পুরো রপ্তানি চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম এর নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ভেঙে যাওয়া। একদিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনাÑ সব মিলিয়ে রপ্তানি খাতের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বড় বাধার মুখে পড়ছে।’
বৈদেশিক আয়ে প্রভাব ও বিনিয়োগ ঝুঁকি
তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ জোগান দেয়। সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলোর কারণে শুধু তাৎক্ষণিক আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে ক্রেতাদের আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। এতে নতুন অর্ডার কমে আসা, বিমা খরচ বৃদ্ধি এবং ঝুঁকি প্রিমিয়াম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিজিএমইএ’র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পরপর তিনটি বড় অগ্নিকা-ের প্রভাব শুধু কারখানা পর্যায়ে সীমিত থাকবে না, এটি বিদেশি ক্রেতাদের সিদ্ধান্তেও প্রভাব ফেলবে। তারা বিকল্প উৎসে ঝুঁকতে পারেন।’ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ধরনের দুর্ঘটনা বিনিয়োগকারীদের আস্থায়ও আঘাত হানতে পারে, বিশেষ করে এমন সময় যখন দেশ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে।
করণীয় ও ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সবচেয়ে জরুরি হলো ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি, বিকল্প কার্গো হ্যান্ডলিং ব্যবস্থার ব্যবস্থা এবং বিমা ক্লেম নিষ্পত্তি দ্রুত সম্পন্ন করা। একই সঙ্গে কার্গো ভিলেজে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ডিজিটাল মনিটরিং ও নিরাপত্তা প্রোটোকল পুনর্বিন্যাস করতে হবে। এ ঘটনায় বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছে ডাচ বাংলা চেম্বার অ্যান্ড কমার্স। সংগঠনটি মনে করে, এখনই সময় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের যাতে একই ধরনের দুর্ঘটনা ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করা যায় এবং চলমান বাণিজ্যিক ক্ষতি দ্রুত পূরণ সম্ভব হয়। ১. স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রকাশ : বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে আমাদের আহ্বানÑ ঘটনার সময়রেখা, প্রাথমিক অনুসন্ধান ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের যোগাযোগকেন্দ্র দ্রুত প্রকাশ করা হোক। এতে বিভ্রান্তি কমবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রক্রিয়া সহজ হবে। ২. ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দ্রুত সহায়তা : বিমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি, অক্ষত পণ্য দ্রুত ছাড়পত্র প্রদান এবং প্রয়োজনে ব্যাকলগ মোকাবিলায় অতিরিক্ত ফ্লাইট বা রুটে ছাড় দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। ৩. স্বাধীন প্রযুক্তিগত নিরীক্ষা : কার্গো ভিলেজসহ বিমানবন্দরের গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক স্থাপনাগুলোর অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থার স্বাধীন প্রযুক্তিগত নিরীক্ষা সম্পন্ন করে সেই প্রতিবেদন প্রকাশ ও বাস্তবায়নের সময়সূচি নির্ধারণ করতে হবে। ৪. বিকল্প চালানপথ ও অস্থায়ী কার্গো হাব : বন্দর, এয়ারলাইন ও ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের সহযোগিতায় বিকল্প পরিবহনপথ এবং অস্থায়ী কার্গো হাব স্থাপন জরুরি, যাতে বাণিজ্যিক ব্যাঘাত ও ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম থাকে। ৫. ক্ষতিপূরণ ও ঝুঁকি-বণ্টন নীতিমালা : সরকার, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং শিল্প-বাণিজ্য সংগঠনগুলোর মধ্যে যৌথ আলোচনার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ, বিমা দাবি ও অবকাঠামোগত ঝুঁকি বণ্টনের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এটি ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন