রাজধানীর পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়ার কিলিং মিশিনে ছয়জন অংশ নিয়েছিলেন। তিনটি মোটরসাইকেলে এসে এই হত্যাকা- ঘটান তারা। আটক যুবককে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। পারিবারিক, রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা সূত্র মতে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ক্ষোভের পাত্র ছিলেন যুবদলের নেতা গোলাম কিবরিয়া। তা ছাড়া তিনি এবার স্থানীয় কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন; সেটাও তার জন্য কাল হয়েছে। কিবরিয়া ৫ আগস্টের পর নিজেকে উন্নত মানের রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন; যে কারণে মাদক ব্যবসায়ে বাধা এবং রাজনৈতিক নেতাদের চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় তাকে খুন করা হয়েছে। তিনি রাজনৈতিক ও আন্ডারওয়ার্ল্ড দ্বন্দ্বে হত্যাকা-ের শিকার হন।
পুলিশ বলছে, কিলিং মিশন নেওয়া ৬ জনই শীর্ষ সন্ত্রাসী। কিবরিয়ার শরীরে ১৮ ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই দুর্বৃত্তরা দোকানের ভেতর ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। এ সময় সিসিটিভির ক্যামেরায় দেখা যায় দুর্বৃত্তদের প্রত্যেকের মাথায় হেলমেট ও মুখে মুখোশ। তবে এই হত্যা কেউই মানতে পারছেন না। নির্মম এ খুনের বিচার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় নেতারা ও নিহতের পরিবার। তাদের দাবি- অপরাধীদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হোক।
এর আগে গত সোমবার রাতে রাজধানীর পল্লবীতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে পল্লবীর পুরোনো থানার কাছে সি-ব্লকে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে এ হত্যাকা- ঘটে। ঘটনার পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, দোকানে মাস্ক ও হেলমেট পরা তিন ব্যক্তি ঢুকে খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে চলে যায়। এ সময় তিনি দোকানে থাকা চেয়ার ধরে লুকানোর চেষ্টা করেন। পাশে অন্যরা থাকলেও অস্ত্রধারীদের কিছুই করতে পারেননি। মাত্র ১০ থেকেই ১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই হত্যা করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল আলম বলেন, ‘যুবদল নেতা কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় অপরাধীদের ধরতে আমাদের একাধিক বিশেষ টিম কাজ করছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি জানান, ঘটনার সময় রাত ৮টার দিকে গুলিবিদ্ধ কিবরিয়াকে শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে জানান। তার ময়নাতদন্তের ফাইনাল রিপোর্ট হাতে পেলে এই ঘটনার আরও তথ্য-প্রমাণ মিলবে এবং আপরাধীদের ধরতে সহজ হবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে অত্র এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরতে আমাদের থানা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযানে নেমেছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান জানান, ঘটনার সময় জনি নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে চিহ্নিত সন্ত্রাসী পাতা সোহেল, ভাগনে মাসুম, দর্জি মামুন, বোমা কালু ও রোকনের নাম উঠে এসেছে। তারা ছয়জন কিলিং মিশনে অংশ নেন। এর সবাই চিহ্নিত অপরাধী।
আন্ডারওয়ার্ল্ড, ব্যাবসায়িক, রাজনৈতিক, নাকি মাদক নিয়ে দ্বন্দ্বে খুনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাবসায়িক, রাজনৈতিক নাকি মাদক নিয়ে দ্বন্দ্ব তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কানেকশনের কোনো বিষয় রয়েছে কি না সেটাও তদন্ত করছে পুলিশ। এই ঘটনায় জড়িত কোনো অপরাধীদের ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
কেউই মানতে পারছেন না নির্মম এ হত্যা : এদিকে কিবরিয়ার মরদেহ মিরপুরের নিজ বাসায় নেওয়ার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন ও এলাকাবাসী। কেউই মানতে পারছেন না নির্মম এ হত্যা। এ হত্যাকা-ের বিচারের দাবি জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা, স্থানীয়রা ও নিহতের পরিবার। তাদের দাবি- অপরাধীদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হোক। ঘটনার পর মরদেহ দেখতে ছুটে আসেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আহ্বান জানান তিনি। এর আগে গতকাল সকালে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাশাত জাবিনের করা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিবরিয়ার শরীরে ১৮টি ক্ষতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকে একটি দোকানে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে।
কিলিং মিশনে তিন মোটরসাইকেলে অংশ নেয় ৬ খুনি : পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়ার কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল ৬ জন। সন্ত্রাসী পাতা সোহেল, ভাগ্নে মাসুম, দর্জি মামুন, বোমা কালু, জনি ও রোকন এসেছিল তিন বাইকে। মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকের ৫ নম্বর রোডের বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারি দোকানের সামনে। ওই দোকানের সামনে কিবরিয়াকে ধাওয়া করে সন্ত্রাসীরা। ধাওয়া খেয়ে কিবরিয়া বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার দোকানে আত্মরক্ষার্থে প্রবেশ করলে সেখানে তিন সন্ত্রাসী উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে হত্যা নিশ্চিত করার পর পালিয়ে যায়। পালানোর সময় কিলিং মিশনে অংশ নেয়া একজন মোটরসাইকেলে চড়তে না পেরে তিনি দৌড়াতে থাকেন। একপর্যায়ে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় উঠে পালাতে চাইলে অটোরিকশাচালক রিকশা চালাতে অস্বীকার করে। এ সময় ওই সন্ত্রাসী অটোরিকশাচালককে গুলি করে। জনতা ধাওয়া করে তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। তার নাম জনি। আটকজনিকে জিজ্ঞাসাবাদে কিবরিয়া কিলিং মিশনে কারা অংশ নিয়েছিল, তাদের নাম পেয়েছে পুলিশ। এদের সাথে সংযোগ আছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের।
ঘটনার পর নিহতের স্বজন ও বন্ধুরা বলছে, এলাকায় তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে হত্যা করিয়েছে কিবরিয়াকে। এদিকে, কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় গতকাল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। নিহতের স্ত্রী সাবিহা আখতার বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় দর্জি মামুন, পাতা সোহেল, জনি, বোমা কালু, রোকন, ভাগ্নে মাসুমসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পল্লবীর শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনের টার্গেট : ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর পল্লবী এলাকায় সক্রিয় হয়ে ওঠে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনের অনুসারীরা। জমি দখল, চাঁদাবাজি এবং চাঁদা না পেয়ে গোলাগুলির ঘটনা নিত্যদিনের বিষয় হয়ে উঠেছে। মাস তিনেক আগে পল্লবীতে একটি ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে মামুন। এ ঘটনায় ওই প্রতিষ্ঠানের একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে গুলির ঘটনাও ঘটে। এসব অপরাধে মামুনের ভাই জামিলুর ও মশিউরের নামে থানায় একাধিক অভিযোগও জমা পড়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের তালিকার উপরিভাগেই তাদের নাম রয়েছে। এরপরও তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অন্যদিকে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে স্থানীয় রাজনীতিতে দ্রুতই পরিচিতি পান গোলাম কিবরিয়া। এই অল্প সময়েই স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তার লাভ করেন। আধিপত্যকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুদিন থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এর জের ধরেই হত্যাকা- ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কিবরিয়া দ্রুতই স্থানীয় রাজনীতিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাই প্রতিপক্ষরা এই হত্যাকা- ঘটিয়ে থাকতে পারে। কে বা কারা এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত জানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তারা শুধু এই হত্যাকা-ের বিচার দাবি করেছেন।
মরদেহ দেখতে কিবরিয়ার বাড়িতে আসেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কিবরিয়া ছিল জনপ্রিয় তরুণ নেতা। কী কারণে, কারা তাকে হত্যা করেছেÑ বিষয়টি তদন্ত করার অনুরোধ রইল পুলিশের কাছে। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে আটক করেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।’ আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আহ্বান জানান। গতকাল মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত জনি নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তদন্তকাজ চলছে, একই সঙ্গে দোষীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।
হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ : হত্যার প্রতিবাদে গতকাল কাকরাইলে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জাতীয়তাবাদী যুবদল। কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়নের নেতৃত্বে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় যুবদল নেতাকর্মীরা হত্যাকা-ের দ্রুত বিচার ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি রেজাউল করিম পল, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক খন্দকার এনাম, সদস্যসচিব নুরুল ইসলাম নয়নসহ মহানগর ও থানা পর্যায়ের যুবদল নেতাকর্মীরা অংশ নেন।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন