কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন সরকারের কঠোর দমন-পীড়নে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পরিণত হয় গত বছরের জুলাইয়ে। ২০২৪ সালের এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাদের হেফাজতে নেয়। এ নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পাঁচজনকে ডিবির হেফাজতে নেওয়া হয়। পরদিন শনিবার ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার জানান, ‘গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে জানতে ও তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।’ এর আগের দিন ২৬ জুলাই বিকেলে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসারত অবস্থায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করে আদালতের রায়ের পর সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনকে এদিন প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এদিন রাতে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন তিন দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। এসব দাবি মানা না হলে পরবর্তীতে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার কথা জানান তারা। শিক্ষার্থীদের তিন দফার অন্যতম ছিলÑ সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদসহ আটক সব শিক্ষার্থীর মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থী গণহত্যার সাথে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সব দোষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়করা জানান, পুলিশের ধরপাকড়সহ নানা কারণে সব সমন্বয়কের সাথে তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না। যে কারণে সমন্বিতভাবে তারা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারছেন না। আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, ‘আন্দোলনের মূল দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে বলে প্রচার করছে সরকার। কিন্তু আমাদের দাবি ছিল কমিশন গঠন করে এই সংকটের সমাধান করা। কিন্তু সেটি করা হয়নি বলেই আমরা এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাখ্যান করছি।’ সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে’। তিনি জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই তিন দফা না মানা হলে পরশুদিন থেকে শিক্ষার্থীরা আরও কঠিন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে।
সংবাদ সম্মেলনে রোববার থেকে সারা দেশে অনলাইন ও অফলাইন ব্যবহার করে প্রচার কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় আন্দোলনকারীরা। একই সঙ্গে বিভিন্ন দূতাবাসে দলিল পেশ করার পাশাপাশি সারা দেশে দেয়াল লিখন কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলন থেকে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় ২৬৬ জন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। এ ছাড়া ছাত্রদের নামে করা মামলাগুলোকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া সোমবার থেকে সারা দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জেলা, উপজেলা ও নগরকেন্দ্রিক ‘হেলথ ফোর্স’ গঠন করে আহত-নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি এবং আহত-নিহত ছাত্র-নাগরিক ও তাদের পরিবারকে মানসিক ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা এবং ‘লিগ্যাল ফোর্স’ গঠন করে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের নামে মামলার ডকুমেন্টেশন এবং যাদের আইনি সাহায্যের প্রয়োজন তাদের সাহায্যের ব্যবস্থা করারও ঘোষণা দেওয়া হয়।
এদিকে ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়কের খোঁজ নিতে এদিন বিকেলে ডিবি কার্যালয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল। তারা সেখানে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করলেও ডিবিপ্রধান শিক্ষকদের সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংকট উত্তরণের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট দিয়ে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বল্প সময়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পক্ষে মত দেন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ছাড়া বাংলাদেশে হত্যাকা- বন্ধে তিনি বিদেশিদের প্রতি সহায়তার আহ্বান জানান।
এদিন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা দেশে ৭৩৬টির বেশি মামলা হয়। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই মামলা হয় ২০৭টি। ঢাকাতে গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ৫৩৬ জন। এর বাইরে র্যাবের অভিযানে ঢাকায় গ্রেপ্তার হয় ৭১ জন। সব মিলিয়ে সারা দেশে গ্রেপ্তার ৭ হাজার ছাড়ায়। ঢাকাসহ সারা দেশের যেসব মামলা হয় তার বেশির ভাগ মামলার বাদী ছিল পুলিশ। এদিন সহিংসতায় আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় তিনি আহত চিকিৎসাধীন কয়েকজনের সাথে কথা বলেন এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। পরে শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শন করেন।
তিনি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজার ক্ষয়ক্ষতিও ঘুরে দেখেন। এদিন ওবায়দুল কাদের মেট্রোরেল চালুর বিষয়ে জানান, ‘মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন ধ্বংস করা হয়েছে। যন্ত্রপাতি এনে এটা এক বছরেও সচল করা সম্ভব হবে না বলে এক্সপার্টরা জানিয়েছেন।’ সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস ২৮ জুলাই রোববার থেকে ৩০ জুলাই মঙ্গলবার পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। অন্যদিকে সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে নেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ। তারা সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের যেন হয়রানি করা না হয়, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানায়।
অন্যদিকে আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাতে প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের ঘটনায় ঢাকায় অবস্থিত ১৪টি মিশন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের কাছে লেখা এক যৌথ চিঠিতে গভীরভাবে উদ্বেগের কথা জানায়। আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ককে চিঠি লিখেন শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। সেই সঙ্গে তারা এ বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। ১৪০ জনের বেশি বিশিষ্ট ব্যক্তি এ চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।