২০২৪ সালের আজকের দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ঘোষণায় বলা হয়, পরদিন ৩১ জুলাই দুপুরে সারা দেশে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করবে তারা। অনলাইনে বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে আজ রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই কর্মসূচির কথা জানানো হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের রাত সোয়া ১১টার দিকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
ঘোষণায় বলা হয়, ‘সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা, গুম-খুনের প্রতিবাদে এবং জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে এবং ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে আগামীকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হবে।’
ঘোষণায় আরও বলা হয়, ‘আমরা সারা দেশের শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও সব নাগরিককে আমাদের কর্মসূচি পালনে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমাদের দাবি আদায়ের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।’
আজকের দিনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তুলে তা অনলাইনে প্রচারের কর্মসূচি পালন করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রোফাইল এদিন লাল রঙের ফ্রেমে রাঙান অনেকে। এসব ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে এদিন দেশব্যাপী এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়। এদিন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কালো ব্যাজ ধারণ করে কার্যালয়ে উপস্থিত হন। এ ছাড়া দেশের সব মসজিদে দোয়া-মোনাজাতের আয়োজন করা হয়, মন্দির-গির্জা-প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে শোক দিবস উপলক্ষে দোয়া ও মিলাদ মহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সারা দেশে শোক পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর রাতে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির পক্ষে রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে মুখ ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলার কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হত্যাকা-ের পর দেশব্যাপী আটক ও নির্যাতনের প্রতিবাদে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
এদিকে, দেশে ছাত্র-জনতা হত্যা, নির্যাতন, গণগ্রেপ্তার, হামলা-মামলার প্রতিবাদ জানান সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মানুষ। তারা রাজধানীর গুলিস্তানে প্রতিবাদী গানের মিছিল করেন। এ সময় মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে বাগ্্বিত-া ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এদিন পুরানা পল্টন মোড়ে আয়োজিত এক সমাবেশ থেকে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারাও সরকারের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করেন।
এদিকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধাপে ধাপে খোলা হবে বলে এদিন জানান শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাত মন্ত্রী, চার সচিব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা জননিরাপত্তা ও ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে চাই। ইন্টারনেট যেহেতু সচল হয়েছে, সেহেতু অনলাইনে ক্লাসের শুরুর বিষয়টি বিবেচনায় নেব।’
অন্যদিকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কসহ ডিবিতে আটক অন্যদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া না হলে আরও কঠোর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে বলে জানায় বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ। এদিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী সংঘাত-সহিংসতার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সহযোগিতা চান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘের কাছেও আবেদন করেছি। আন্তর্জাতিকভাবেও বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে দেশে-বিদেশে, তাদের কাছেও আমরা সহযোগিতা চাই যে এ ঘটনার যথাযথ সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং যারা এতে দোষী, তাদের সাজার ব্যবস্থা হোক। কারণ, আমি জানি, এতে আমার কোনো ঘাটতি ছিল না।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় এদিন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় ২৬৪টি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৫৩টি। আরও পাঁচটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছিল। সব মিলিয়ে ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয় ২ হাজার ৮৫০ জনকে। সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও কিছু দাবি তুলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে একটি খোলাচিঠি লেখেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড। ওই চিঠিতে ক্যালামার্ড বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাম্প্রতিক সহিংস দমন অভিযানের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে মহানগর, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ‘সন্ত্রাস ও নাশকতা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করতে সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন বলে এদিন জানান জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।